বিশ্বকাপে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা প্রতিটি ক্রীড়াবিদেরই স্বপ্ন। ব্যতিক্রম ছিলেন না এই ক্রিকেটারও। বিশ্বকাপের দুই মাস আগেও দলকে টেনে তুলেছিলেন খাঁদের কিনারা থেকে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮ রানে চার উইকেট হারানোর পর ৯০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে দলকে এনে দিয়েছিলেন জয়। অথচ সেই তাকেই কিনা বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ দেয়া হলো কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। তিনি আম্বাতি রাউডু, ভাগ্য যার প্রতি সদয় হয়নি কখনোই।
আম্বাতি রাইডুর বেড়ে ওঠা অন্ধ্রপ্রদেশের ছোট শহর গুন্তুরে। আর্কাইভ অফিসে চাকুরে বাবার উৎসাহেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি রাইডুর। বাবার স্কুটারে চেপেই প্রতিদিন অনুশীলন এবং ম্যাচ খেলতে যেতেন। হায়দ্রাবাদের সাবেক ক্রিকেটার বিজয় পালের একাডেমিতেই ধীরে ধীরে অঙ্কুর থেকে ফুল হয়ে ফোটেন রাইডু। ভারতীয় ক্রিকেটে তার আগমন ধূমকেতুর মত।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই হায়দ্রাবাদের হয়ে অভিষেকের পাশাপাশি ডাক পান ভারত এ দলে। ছিলেন ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক। ২০০২ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে তিন ম্যাচে ২৯১ রান করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট আঙিনায়। বিশেষ করে তৃতীয় ম্যাচে তার করা ১৬৯ বলে ১৭৭ রানের ইনিংস নজর কেড়েছিল গোটা বিশ্ববাসীর।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও ছিলেন ভারতের দলপতি। সেবার অবশ্য সেমিফাইনালেই থেমে যায় ভারতের বিশ্বকাপ যাত্রা, যদিও ফাইনালে ওঠার সেই লড়াইয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে পারেননি তিনি। আগের ম্যাচে আইসিসির কোড অব কন্ডাক্ট ভঙ্গের ডাগআউটে বসেই তাকে দেখতে হয় দলের পরাজয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই রঞ্জি ট্রফিতে একই ম্যাচে খেলেন ২১০ এবং অপরাজিত ১৫৯ রানের ইনিংস। রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে তিনি একই ম্যাচে ডাবল-সেঞ্চুরি এবং সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন। কিন্তু এরপরই পতনের শুরু রাইডুর ক্যারিয়ারে।
অর্থের লোভে বিদ্রোহী ক্রিকেট আইসিএলে যোগ দেন রাইডু। ফলশ্রুতিতে থমকে যায় তার ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ার। তবে নিজের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুতই শোধরে নেন নিজেকে। বিসিসিআইয়ের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে পুনরায় ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান। তবে ততদিনে বদলে গিয়েছে তার রঞ্জি ট্রফির ঠিকানা। হায়দ্রাবাদ, অন্ধ্রপ্রদেশ হয়ে এবার তিনি খেলতে শুরু করেন বরোদার হয়ে।
২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ঘোষিত ত্রিশ সদস্যের প্রাথমিক দলে থাকলেও মূল দলে জায়গা পাননি রাইডু। অবশ্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি এরপর, ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করার সুবাদে সুযোগ পেয়ে যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবার। ভারতের জিম্বাবুয়ে সফরের ঠিক আগে মহেন্দ্র সিং ধোনি ইনজুরির কারণে ছিটকে গেলে তাঁর জায়গায় সুযোগ পান রাইডু।
একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচেই নিজের জাত চেনান তিনি, অপরাজিত থাকেন ৬৩ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলে। এরপর ধোনি ফিরে এলে আবারও মূল একাদশ থেকে বাদ পড়েন রাইডু। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছেন নিজের সেরাটা দিয়েছেন, কিন্তু ভাগ্য তার প্রতি কখনোই সুপ্রসন্ন হয়নি। ২০১৫ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে থাকলেও কোনো ম্যাচেই মাঠে নামার সুযোগ হয়নি তার।
তবে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ভাগ্যের শিকে ছেড়ে রাইডুর। অন্তত সবাই তাই ভেবেছিলেন। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ধীরে ধীরে নিয়মিত মাঠে নামার সুযোগ পান তিনি। বিরাট কোহলি তিন নম্বরে প্রমোশন পেলে রাইডুকে দেয়া হয় চার নম্বরে ব্যাট করার সুযোগ। সেখানেও খুব একটা খারাপ করেননি, রান করেছেন ৪৭.০৬ গড়ে। বিশ্বকাপের মাস দেড়েক আগেই খেলেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অনবদ্য সেই ইনিংস।
কিন্তু, বিশ্বকাপে ভারতীয় নির্বাচকরা চাচ্ছিলেন এমন কাউকে যিনি কিনা ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল করতে পারেন। ফলে আবারও কপাল পোড়ে রাইডুর, তার বদলে দলে সুযোগ পান বিজয় শংকর। বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটা তার রয়ে যায় অধরাই। রাগে-দুঃখে পরদিনই অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরে অবশ্য তা প্রত্যাখ্যান করে নেন।
আইপিএলেও রাইডুর পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয়। সবাই রাইডুকে চেন্নাইয়ের হলুদ জার্সিতে দেখে অভ্যস্ত হলেও তার আইপিএল ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল মুম্বাইয়ের হয়ে। ২০১৮ আইপিএলে ব্যাট হাতে সবচেয়ে ভালো সময় কাটান রাইডু, সেবার চেন্নাইয়ের হয়ে ১৬ ম্যাচে ৬০২ রান করার পাশাপাশি দলকে এনে দেন শিরোপার স্বাদ। রাইডুকে এখনও চেন্নাইয়ের সমর্থকরা ঘরের ছেলে হিসেবেই বিবেচনা করে।
ভাগ্যবিধাতা কারও প্রতি একটু বেশিই রুষ্ট। রাইডুও হয়তো তাদের দলেই পড়েন, ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় পারফর্ম করে গেলেও প্রাপ্তির খাতাটা তাই শূন্যই।