পেস রহস্যের আঁতুড়ঘর পাকিস্তান

লম্বা গড়ন, চওড়া কাঁধের উপস্থিতি। এরপর দুর্দান্ত গতির সাথে বল ছোঁড়া। একই সাথে ইনসুইং, আউট সুইং, রিভার্স সুইং দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের ভড়কে দেওয়া। পাকিস্তানি পেসারদের বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক এমনই। উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর প্রধান রসদ যেখানে স্পিন বোলিং সেখানে বছরের পর বছর দুর্দান্ত সব পেসার উপহার দিয়ে আসছে পাকিস্তান।

শুরুটা ইমরান খানকে দিয়ে ধরলেও তালিকার শেষটায় কিন্তু এখনও ‘ফুলস্টপ’ বসেনি। কারণ পাকিস্তান থেকে পেসার উঠে আসার গল্প এখনও চলমান। অবশ্য ইমরান খানের আগেও দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন পাকিস্তানের আরেক পেসার ফজল মাহমুদ। মাত্র ২২ টেস্টে পেয়েছিলেন ১০০ উইকেট। আর একশো টেস্ট উইকেট পাওয়া প্রথম পাকিস্তানি বোলারও ছিলেন তিনি।

এরপর থেকেই পাকিস্তান ক্রিকেটে পেসারদের রাজত্ব শুরু হয়। ইমরান খান থেকে শুরু করে একে একে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতার বিশ্ব ক্রিকেটে তাদের পেস দিয়ে জানান দিয়েছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে এখনকার পাকিস্তানি পেসাররাও। শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ, হারিস রউফরা সবাই ধরে রেখেছেন পাকিস্তানের পেস বোলিংয়ের জৌলুশ।

তবে প্রশ্নটা হলো- পাকিস্তান থেকেই কেন এত দুর্দান্ত পেসার বেরিয়ে আসে? দুর্দান্ত অনেক পেসারই বিশ্বের অনেক দেশই দেখেছে, কিন্তু পাকিস্তান যেন পেসারদের জন্য উর্বর ভূমি। এটার কারণ কী? অবকাঠামোগত সুবিধা নাকি সহজাত প্রতিভা? প্রথম কারণ হলো ক্রিকেট সংস্কৃতি। একটা দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি অনেকটাই ঠিক করে দেয় সেই দেশের পরবর্তী সম্পদ কী হতে পারে। তো পাকিস্তানের রয়েছে পেস বোলিং সমৃদ্ধ ইতিহাস। ঐ সমৃদ্ধ ইতিহাসটাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মেদের একটা বার্তা দেয়, এক ধরনের অনুপ্রেরণা জোগায়।

তবে পাকিস্তান থেকে পেসার উঠে আসার পেছনে অবকাঠামোগত সুবিধার চেয়েও বেশি ভূমিকা রেখেছে এখানকার আবহাওয়া, ক্রিকেটারদের শারীরিক গঠন। এই যেমন পাকিস্তান দলের দুইজন পেসার নাসিম শাহ আর শাহনেওয়াহ দাহানি উঠে এসেছেন একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেখানে অবকাঠামোগত কোনো সুযোগ সুবিধা ছিল না বললেই চলে। অথচ নিজেদের প্রতিভা আর পরিশ্রম দিয়েই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন তারা। এ যাত্রায় ছিল অনেক অসাধ্যকে সাধন করার গল্প।

আরেকটি সংস্কৃতি পাকিস্তান ক্রিকেটে বহুদিন ধরে চলমান। সেটি হলো- বহুদিন আগে থেকেই পাকিস্তানে টেনিস বলে ক্রিকেটের চল রয়েছে। টেনিস বলের উপরে টেপ পেঁচিয়ে ক্রিকেট খেলার দৃশ্যটা এখানকার নিয়মিত ঘটনা। টেপ পেঁচিয়ে টেনিস বলে স্পিনাররা তেমন একটা সুবিধা না পেলেও সুবিধা পান পেসাররা। শুধু সুবিধায় নয়, গতি নিয়ে দারুণ একটা ড্রিলও হয় পেসারদের। এ কারণে ক্রিকেট বলে পাকিস্তানের বেশিরভাগ পেসারদের গতি হয় বেশি। সে গতিতে কাবু হয় বিশ্বের নামকরা সব ব্যাটাররাও।

পাকিস্তানের সাবেক কোচ মাইক অ্যাথারটন ২০২০ এর পাকিস্তান সুপার লিগ আসরে অবশ্য এ নিয়ে  একবার বলেছিলেন। পাকিস্তান থেকে এত পেসার উঠে আসার কারণ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, এটার সঙ্গে পাকিস্তানের অবকাঠামোগত দৈন্যের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে । অনেক দারুণ ব্যাটার পেতে হলে আপনার ক্রিকেটীয় সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামো দারুণ হতে হবে, দারুণ অনেক কোচ থাকতে হবে, একটা ক্রিকেট সিস্টেম থাকতে হবে। কিন্তু বোলার যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় উঠে আসতে পারে। সে কারণেই হয়তো পাকিস্তানে এ রকম বোলারের সংখ্যাটা এত বেশি।’

মাইক অ্যাথারটনের কথায় যে কারোর মত বিরোধ থাকতেই পারে। তবে প্রান্তিক অঞ্চল থেকে পাকিস্তানের পেসার উঠে আসায় এক দিক থেকে প্রমাণ করে দেয় যে, অবকাঠামোগত তেমন কোনো সুবিধা নয়, বরং নিজেদের শ্রম আর আদি পেসারদের উজ্জ্বল ইতিহাসে রোমাঞ্চিত হয়ে নিজেদের দারুণ পেসার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

মূলত পেস বোলিংয়ে দারুণ শক্তি আর গভীরতা পাকিস্তানি পেসারদের করে তুলেছে অনন্য। এ কারণেই পাকিস্তান থেকেই এত পেসার উঠে আসে। আর সে গতি প্রবাহের ধারা যে পেস বোলিংয়ের গতির মতোই চলতে থাকবে- তা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলা যায়।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link