বারোদার স্টেডিয়ামে এক বাবা তাঁর ছেলের খেলা দেখতে এসেছেন। বয়সের পরিক্রমায় শরীরে অসুস্থতা জেঁকে বসেছে। তারপরও স্টেডিয়ামে নিজের ছেলের খেলা দেখাতেই যেন সব সুখ তাঁর। ছেলেও গর্বিত। এমন কয়টা বাবা পাওয়া যায় যে নিজের ছেলের প্রতিটি ম্যাচ স্টেডিয়ামে এসে দেখতে আসে আর চিয়ার আপ করে।
কিন্তু, ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণ পর ছেলে আবিষ্কার করলো, তাঁর বাবা যেখানে বসে ছিল সেখানে আর তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। ম্যাচ শেষ করে বেশ তড়িঘড়ি করেই ছেলেটা বাবাকে খুঁজতে গেল। কিন্তু কোথাও বাবার দেখা মেলে না। এরপর কোচ সেই ছেলেটিকে এক পাশে নিয়ে বললেন, ‘তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
ছোট ছেলে হার্ট অ্যাটাকের ভয়াবহতা বুঝে না। তবে ডাক্তারের সুর শুনেই বুঝে গেল, এ যাত্রায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছে তাঁর বাবা। মূলত মাঠে থাকাকালীনই তাঁর বাবার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। এরপর কাউকে না বলে একাই বাসা চলে গিয়েছিলেন তিনি। এসেই অচেতন হয়ে পড়েন। আট নয় দিন ধরে আইসিইউতে ভর্তি থাকতে হয় তাঁকে।
গল্পটা বাবা হিমাংশু পান্ডিয়া আর পুত্র হার্দিক পান্ডিয়ার। বাবা হিমাংশু পান্ডিয়া তেমন স্বচ্ছল ছিলেন না। তবে দুই ছেলে হার্দিক ও ক্রুনাল পান্ডিয়ার ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। গুজরাটের সুরাত শহরে বেড়ে ওঠা দুই ভাইয়ের। সেখানেই একটি ছোট কার ফাইন্যান্সের ব্যবসা চালাতেন তাদের বাবা।
কিন্তু, হার্দিকের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন নিজের ব্যবসা গুটিয়ে তিনি তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন বারোদা শহরে। উদ্দেশ্য একটিই, তাঁর দুই ছেলে যেন ক্রিকেটার হওয়ার পথে সব ধরনের সুবিধা পায়। সেখানে তিনি তার ছেলেদের ভর্তি করে দেন কিরণ মোরের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে।
কিন্তু বারোদায় এসে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে যান হার্দিক পান্ডিয়ার বাবা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাই পরিবার চালাতে তখন হিমশিম অবস্থা পান্ডিয়া ফ্যামিলির। হার্দিক পান্ডিয়া তখন রাজ্য দলে খেলতেন। মাসে হাজার তিনেক রূপি আসতো তাঁর।
কিন্তু হঠাৎই তাঁকে রাজ্যদল থেকে শৃঙ্খলাজনিত কারণে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। হার্দিক তখন বলতে গেলে একেবারে দিশেহারা অবস্থায়। এমনিতে বাবার অসুস্থতা, অন্যদিকে যে সামান্য অর্থ আসতো সেটারও পথ বন্ধ হয়ে গেল। এরপর তিন চারশো রূপিতে স্থানীয় ক্লাবের হয়ে খ্যাপ খেলতে শুরু করেন তিনি। অবস্থা এক পর্যায়ে এমন হয় যে, যে ক্লাবই খেলতে বলে সেখানেই টাকার জন্য খেলতে চলে যেতেন হার্দিক পান্ডিয়া।
হার্দিক পান্ডিয়ার বাবা হার্ট অ্যাটাকের আগে ব্যাংকের ইএমআই নিয়ে একটি ছোট সেডন গাড়ি কিনেছিলেন। তবে গাড়িটা নিজের জন্য নয়, নিয়েছিলেন তাঁর দুই ছেলের জন্য যাতে তারা খুব সহজে প্র্যাক্টিসে যেতে পারে। কিন্তু হার্ট অ্যাটাকের পরই বিপদে পড়ে যান হিমাংশু পান্ডিয়া। ব্যাংকের ইএমআই শোধ করতে পারছিলেন না তিনি। বাবার আয় নেই, সাথে দুই ছেলে যেটুকু টাকা আয় করছে তা যথেষ্ট নয় ঋণ শোধ করার জন্য। সব কিছু মিলিয়ে খুবই বাজে অবস্থা।
তবে হঠাৎই এক পরিবর্তন আসে মাস তিনেক পর। এক ঝটকায় জীবনযাত্রার পথ ঘুরে যায় হার্দিক পান্ডিয়ার। বারোদার হয়ে সেবার টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশীপ জিতে নেয় পান্ডিয়ার দল। সে টুর্নামেন্ট থেকে এক লাখ রূপি পুরস্কার পান তিনি। আর তা দিয়েই গাড়ির ইএমআই এর কিছুটা পরিশোধ করেন হার্দিক পান্ডিয়া।
আর এর বিশ দিন পরেই আইপিএলের নিলামে দল পেয়ে যান হার্দিক পান্ডিয়া। মুম্বাই ইন্ডিয়ানস তাঁকে দলে ভেড়ায় ১০ লাখ রূপিতে। দশ লাখ রূপিতে সেবার আইপিএল খেললেও সেবার মোট ৬০ লাখ আয় করেন তিনি। আর এতেই পরিবারের মোড় ঘুরিয়ে দেন পান্ডিয়া। সকল ধারদেনা শোধ করে একদম স্বস্তিতে জীবন শুরু হয় পান্ডিয়া ফ্যামিলির।
আইপিএলের প্রথম আসরেই নিজেকে বেশ মেলে ধরেছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। ২০১৫ সালের সে আসরেই কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে পেয়েছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। তবে সবচাইতে আলোচনায় এসেছিলেন চেনাইয়ের বিপক্ষে ৮ বলে ২১ রানের ইনিংস খেলে। ঐ ছোট্ট ইনিংসের পরেই সবার নজরে আসেন পান্ডিয়া।
আর সেবারের আইপিএল নিলামে যে শচীন টেন্ডুলকার নিজে থেকে হার্দিককে দলে ভিড়িয়েছিলেন সেই শচীন নিজেও সব সময় বিশ্বাস করতেন, পান্ডিয়া খুব শীঘ্রই জাতীয় দলে খেলবে। শচীনের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়নি।
পরের বছরেই এডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় হার্দিক পান্ডিয়ার। এরপর সে বছরেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে একদিনের ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর। আর ২০১৭ সালে সাদা জার্সিতেও লাল বলের ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় হার্দিক পান্ডিয়ার।
অভিষেক টেস্টের অভিষেক ইনিংসেই ফিফটি। খেললেন ৪৯ বলে ৫০ রানের ইনিংসে। আর ঐ সিরিজেই পাল্লেকেল্লে টেস্টে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। সে টেস্টের দ্বিতীয় দিনে হার্দিক পান্ডিয়া সেঞ্চুরি করেই বাবাকে উপহার দিয়েছিলেন একটা গাড়ি।
ছেলেদের ক্রিকেটার হিসেবে দেখার জন্য বাবা হিমাংশু ব্যবসা ছেড়েছিলেন, ছেলেদের প্র্যাক্টিসের সুবিধার্থে গাড়িও কিনে দিয়েছিলেন। বাবার সেই অসীম ত্যাগকে তো আর কোনো কিছুর বিনিময়ে স্পর্শ করা যায় না। তাই বাবাকে একটি গাড়ি উপহার দিয়ে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া।
হার্দিক পান্ডিয়ার আলো ছড়ানো শুরু এরপর থেকেই। এত আঁধার পেরিয়ে যে আলোর মাঝে এসেছে তাঁকে আবার আঁধারে ঠেলে দেওয়ার সাধ্যি কার আছে! মাঝে ইনজুরির কারণে বেশ কিছুদিন দলের বাইরে থাকলেও ফিরে এসেছিলেন রাজসিক প্রত্যাবর্তন দিয়ে।
আইপিএলে এবার তাঁর কাঁধে উঠেছিল নেতৃত্বের দায়িত্ব। নতুন দল গুজরাট টাইটান্সের অধিনায়ক হিসেবে প্রথম আসরেই জিতেছেন আইপিএল শিরোপা। ব্যাটিং, বোলিং সাথে ক্যাপ্টেন্সি- সব মিলিয়ে এবার পুরো আইপিএলটাই নিজের করে নিয়েছিলেন হার্দিক পান্ডিয়া। ব্যাট হাতে ৪৮৭ রান করার পাশাপাশি বল হাতেও নিয়েছিলেন ৮ উইকেট।
এরপর এশিয়া কাপে এসেও দেখিয়েছেন চমক। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটা বলতে গেলে একাই জিতিয়েছিলেন তিনি। ভারতের সীমিত ওভারের ক্রিকেট দলে তাই অটোমেটিক চয়েস হয়ে উঠেছেন হার্দিক পান্ডিয়া। দারুণ ব্যাটিংয়ের সাথে দুর্দান্ত পেসে বোলিং। কপিল দেব পরবর্তী যুগে তাহলে হার্দিক পান্ডিয়াই কি সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার? যদিও হার্দিক পান্ডিয়া বলের চেয়ে ব্যাটেই আগ্রাসী বেশি।
২০১৩ সালে বরোদার হয়ে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি খেলার সময় ৫ রুপি দিয়ে ম্যাগি নুডলস কিনে বাগানের মালির কাছে গরম পানি চেয়ে নুডলস তৈরি করতেন হার্দিক পান্ডিয়া। সেটাই সকালের নাশতা, আবার দুপুরেরও খাবার। পান্ডিয়ার কথা মতো ৩৬৫ দিনই নুডলস খেতেন তারা দুই ভাই। সেই হার্দিক পান্ডিয়ার এখন জীবন পাল্টেছে। তবে সংগ্রামমুখর জীবন কি স্মৃতির পাতায় বন্দী করে ফেলেছেন?
হার্দিক পান্ডিয়ার জীবনে গতি এসেছে, যশ, খ্যাতি, অর্থ- সব এসেছে। তবে এখনো নাকি সেই ৫ টাকার ম্যাগি নুডলস খান হার্দিক পান্ডিয়া! নিজের সংগ্রামমুখর জীবন ফেলে আসলেও এখনও জীবন দর্শন ফেলে আসেননি তিনি।
উচ্চ অট্টালিকা কিংবা অর্থ প্রতিপত্তির জৌলুশে ভেসে যাননি পান্ডিয়া। কারণ তিনি সংগ্রামের অর্থ জানেন, বোঝেন আর এটাও জানেন, একজন সংগ্রামী আর স্বাপ্নিক বাবার কারণেই তিনি আজ এখানে। তবে শূণ্য থেকে শিখরে যাওয়ার পথে শত প্রতি প্রতিকূলতার স্বাদ নেওয়া হার্দিক পান্ডিয়া হয়তো ‘জীবন’ এর সংজ্ঞাটা আরও ভালভাবেই দিতে পারবেন।