ক্রিকেট ইতিহাসে প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ হলেও কিছু তারিখ একটু বেশিই অর্থবহ। ১৪ অক্টোবর তেমনই এক দিন। এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করা অসাধারণ সব ক্রিকেটার। কেবল তাঁদের নিয়েই সাজিয়ে ফেলা যায় দারুণ কার্যকরী এক একাদশ। আসুন দেখে নেয়া যাক আজকের দিনে জন্ম নেয়া ক্রিকেটারদের একাদশ। ভিন্নধর্মী এই আয়োজনই থাকছে খেলা-৭১ এর আজকের আয়োজনে।
- তিলকরত্নে দিলশান (শ্রীলঙ্কা)
শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার তিলকরত্নে দিলশান জন্মেছিলেন ১৯৭৬ সালের ১৪ অক্টোবর। সানাত জয়াসুরিয়া এবং রমেশ কালুভিতারানার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে শ্রীলঙ্কাকে বিধ্বংসী সব শুরু এনে দিয়েছেন। নিজের অভিষেক সিরিজেই এক ম্যাচে ১৬৩ রানের ইনিংস খেলে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। টেকনিক্যালি ভালো, পেসের বিপক্ষে স্বাচ্ছন্দ্য, দারুণ ফুটওয়ার্ক, অনবদ্য কব্জির মোচড়- সবমিলিয়ে একজন পারফেক্ট ওপেনারের সব গুণই ছিল তাঁর মাঝে।
২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। উইকেট রক্ষকের মাথার উপর ফ্লিক করে বল সীমানা ছাড়া করার দারুণ এক শটের উদ্ভাবক তিনি, দর্শকরা যার নাম দিয়েছে “দিলস্কুপ”। ২০১১ বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কার অধিনায়কও ছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে এই একাদশকে ঝড়ো শুরু এনে দেয়ার দায়িত্বটা তাই বর্তেছে দিলশানের কাঁধেই।
- শান মাসুদ (পাকিস্তান)
আক্রমণাত্নক, মারকুটে দিলশানের পাশে প্রয়োজন ছিল ধীরস্থির মেজাজের কাউকে, যিনি কিনা উইকেটের একপাশ আগলে খেলতে জানেন। পাকিস্তানি ওপেনার শান মাসুদ সেই ঘরানারই ব্যাটসম্যান। পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেও এই ক্রিকেটারের শুরুটা ইংল্যান্ডে, সেখানে খেলেছেন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্রিকেট। নিজের ২৪তম জন্মদিনে পাকিস্তানের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তাঁর।
জন্মদিনটা তিনি রাঙ্গিয়েছিলেন দারুণভাবেই, স্টেইন-ফিল্যান্ডারদের সামলে খেলেছিলেন ৭৫ রানের দারুণ এক ইনিংস। নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই ইংলিশ বোলারদের সামলে ব্যাট করেছেন প্রায় আট ঘন্টা। বেশিরভাগ সময়ে লাল বলের জন্য বিবেচনা করা হলেও বিগত বছরে সাদা বলের ক্রিকেটেও দারুণ উন্নতি করেছেন এই ব্যাটার। এই একাদশে তাই দিলশানের সঙ্গী হিসেবে উদ্বোধন করতে নামবেন শান।
- গৌতম গম্ভীর (ভারত)
এই শতাব্দীতে ভারতের দুইটি বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল গৌতম গম্ভীরের। দুইটি বিশ্বকাপের ফাইনালের চাপ সামলে খেলেছিলেন দুর্দান্ত দু’টি ইনিংস। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংসের পাশাপাশি সেনবারের টুর্নামেন্টে হাঁকিয়েছিলেন তিনটি ফিফটি। চার বছর বাদে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে আরো উজ্জ্বল গম্ভীর।
মুম্বাইয়ের সেই ফাইনালে শুরুতেই শেবাগ-শচীন ফিরে গেলে ৯৭ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন গম্ভীর। ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি গম্ভীরের ক্রিকেট মস্তিষ্কও দারুণ,অধিনায়ক হিসেবে আইপিএলে কলকাতাকে শিরোপা জিতিয়েছেন দুইবার। তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি এই একাদশের অধিনায়কত্ব করার গুরুদায়িত্বটাও তাই থাকবে গম্ভীরের কাঁধে।
- গ্লেন ম্যাক্সওয়েল (অস্ট্রেলিয়া)
রিভার্স সুইপ আর সুইচ হিটের পাশাপাশি বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের বিশ্বজুড়ে ফ্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর প্রধান আকর্ষণ গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। আধুনিক ক্রিকেটের মহাতারকা হয়ে ওঠার সব গুণাবলি রয়েছে তাঁর মাঝে। বিধ্বংসী ব্যাটিং, ক্ষীপ্র ফিল্ডিং এর পাশাপাশি তাঁর ডান-হাতি অফস্পিনও দারুণ কার্যকরী সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। ২০১৫ বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন মাত্র ৫১ বলে। বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি সেটি। টেস্ট ক্রিকেটে নিয়মিত না হলেও, ভারতের বিপক্ষে চার ঘন্টা ব্যাট করে ১০৪ রানের ইনিংস রয়েছে তাঁর।
- জ্যাক ক্র্যাপ (ইংল্যান্ড)
খেলোয়াড়ি জীবনে ইংল্যান্ডের হয়ে সাত টেস্টে মাঠে নামা বাঁ-হাতি ব্যাটার জ্যাক ক্র্যাপ পরবর্তীতে ছিলেন আম্পায়ারও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে মূল্যবান বছরগুলো হারিয়ে না গেলে ক্রিকেট ইতিহাসের স্মরণীয় এক নাম হয়ে ওঠার সামর্থ্য ছিল তাঁর। তাঁর প্রথম শ্রেণির রেকর্ডের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, ৩৮ সেঞ্চুরিতে তাঁর সংগ্রহ ২৩,৬১৫ রান। এই একাদশের মিডল অর্ডার সামলানোর দায়িত্ব তাই থাকবে এই ইংলিশম্যানের উপর।
- রশিদ লতিফ (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের সাবেক উইকেটকিপার রশিদ লতিফ থাকবেন এই একাদশের উইকেট সামলানোর দায়িত্বে। কিপিংয়ের পাশাপাশি ব্যাট হাতেও ছিলেন সমান সাবলীল, উইকেটের চারপাশেই শট খেলতে জানতেন। ওভালে অভিষেক ম্যাচেই হাঁকিয়েছিলেন দারুণ এক ফিফটি। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে রশিদ লতিফ থাকবেন খলনায়ক হয়েই। ২০০৩ সালে মুলতানে অলক কাপালির ক্যাচ হাত থেকে ফেলে দিলেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আউট করেন কাপালিকে। তাঁর প্রতারণার কারণেই সেবার ম্যাচ জিতে নেয়ার সুযোগ পায় পাকিস্তান। সেই টেস্টের পরই তাঁর ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে।
- ডগ রিং (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ায়ন অলরাউন্ডার ডগ রিং বিখ্যাত ছিলেন তাঁর মারকুটে ব্যাটিংয়ের কারণে। এছাড়া তাঁর লেগস্পিনের হাতটাও চমৎকার। অজিদের হয়ে মাঠে নেমেছেন ১৩ টেস্টে। তবে তাঁর ক্যারিয়ারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৯৫১-৫২ মেলবোর্ন টেস্ট। সেবার ক্যারিবীয় পেস ব্যাটারির সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে শেষ উইকেটে বিল জনস্টনের সাথে ৩৮ রানের জুটি গড়ে দলকে এনে দিয়েছিলে অবিশ্বাস্য এক জয়।
- অ্যাশটন অ্যাগার (অস্ট্রেলিয়া)
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট অভিষেকেই রেকর্ডবুক উল্টেপাল্টে দিয়েছিলেন বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার অ্যাশটন অ্যাগার। ১১৭ রানে নয় উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা অজিদের পথ দেখিয়েছিলেন অ্যাগার। এগারো নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ৯৮ রানের এক অসাধারণ এক ইনিংস। এগারোতে নামা কোনো অভিষিক্তের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। কিন্তু নাথান লায়নের কারণে ক্যারিয়ারের গ্রাফটা খুব একটা উর্ধ্বগামী হয়নি অ্যাগারের। তবে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ তিনি।
- সাঈদ আজমল (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্পিনার সাঈদ আজমল। রহস্য স্পিনার হিসেবে ক্রিকেটবিশ্বে রাজত্ব করেছেন প্রায় এক দশক। অফস্পিনের মায়াজালে বিদ্ধ করে বারবার সাজঘরে পাঠিয়েছেন বিশ্বসেরা সব ব্যাটসম্যানদের। বোলিং অ্যাকশন নিয়ে বারবার নিষেধাজ্ঞায় পড়লেও প্রতিবারই ফিরে এসেছেন প্রবলভাবেই। ১৩ উইকেট শিকার করে পাকিস্তানকে জিতিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা। “তিসরা” নামে অফস্পিনের এক নতুন ডেলিভারির আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। লাল বলের ক্রিকেটে ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত না হলেও সাদা বলের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন বিধ্বংসী এক বোলার।
- চার্লি পার্কার (ইংল্যান্ড)
গ্লুস্টারশায়ারে জন্ম নেয়া চার্লি পার্কার ইংল্যান্ডের হয়ে মাত্র এক টেস্টে মাঠে নামলেও ঘরোয়া ক্রিকেট রাজত্ব করেছেন বহুদিন। উইলফ্রেড রোডস এবং ফ্রিড টিচম্যানের পর ৩২৭৯ উইকেট নিয়ে তিনিই তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ইনিংসে আট বার পেয়েছিলেন নয় উইকেটের দেখা। সেই সময়ের স্যাঁতসেঁতে উইকেটে রীতিমত অপ্রতিরোধ্য ছিলেন বাঁ-হাতি স্পিনার পার্কার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে খেলা একমাত্র টেস্টে দুই উইকেট পান পার্কার।
- জন ল্যাশ (অস্ট্রেলিয়া)
এই একাদশের একমাত্র স্পেশালিস্ট পেসারের দায়িত্বে থাকবেন জন ল্যাশ। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে জাতীয় দলে ডাক না পেলেও নিউ সাউথ ওয়েলশের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ ছিলেন তিনি। দারুণ গতি আর সুইং দিয়ে ব্যাটারদের নাস্তানাবুদ করতে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল অজিদের ঘরোয়া ক্রিকেট মহলে।