ড্যানি মরিসনের মাঠের ক্যারিয়ারের গল্পে দারুণ সব ঘটনাবলি জড়িত। একালে সর্বদা বিনোদনে মাতোয়ারা এই ব্যক্তি বল হাতে ছিলেন দূর্দান্ত। প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের বল হাতে বিভ্রান্ত করতে ছিলেন ওস্তাদ।
ক্রিকেট মাঠে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের প্রথম হ্যাটট্রিক ম্যান। ১৯৯৪ পরপর তিন বলে ভারতের তিন ব্যাটসম্যান কে বোল্ড করে তিনি এই কীর্তি গড়েন। স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন এক বোলিং একশানে বাইশ গজে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আউটস্যুইং ডেলিভারি ছিলো তার কাছে হরহামেশা ব্যাপার। ব্যাটসম্যান বিভ্রান্ত করতে এই বল ছিলো দারুণ উপযোগী। ক্যারিয়ারে কিংবদন্তি রিচার্ড হ্যাডলির সাথে জুটি বেঁধে কিউইদের বহু ম্যাচ জিতিয়েছেন।
অভিষেকের স্মৃতি খুব একটা জাঁকজমক ছিলোনা। ১৯৮৭ বিশ্বাকাপে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠে নামলেও, ততক্ষণে বিশ্বকাপ থেকে ব্ল্যাকক্যাপসদের বিদায়ের ঘন্টা নিশ্চিত হয়ে যায়। চেতন শর্মার হ্যাটট্রিকের দিনে প্রথমবারের মত মাঠে নামা ছেলেটাই তার ঠিক সাত বছর পর হয়েছিলো ব্ল্যাক ক্যাপদের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম হ্যাট্রিক ম্যান। ব্যাট হাতে মাঠে নামার সু্যোগ মেলেনি সেদিন মরিসনের। বল হাতেও সুবিধে করতে পারেননি বাকি সতীর্থদের মত। নিউজিল্যান্ড সে ম্যাচ হেরেছিল নয় উইকেটের ব্যবধানে। যদিও তার বছর দুয়েক বাদের গল্পটা একেবারেই ভিন্ন ড্যানি মরিসনের জন্য।
১৯৮৯-৯০ মৌসুমে বল হাতে তার নৈপুণ্যে দলের ঝুলিতে ধরা দিয়েছিলো একের পর এক সফলতা। দলের সিনিয়র সদস্যদের টপকে ড্যানি নিউজিল্যান্ডের হয়ে বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব জেতেন। ড্যানির ক্রিকেট ক্যারিয়ারে এই খেতাব তার নামের পাশে তারকাখ্যাতির জন্ম দিয়ে দেয়। কিউই সমর্থকদের কাছে ভরসার প্রতীক হিসেবে আবির্ভাব হতে থাকেন। দূর্দান্ত আউটসুইংয়ে ব্যাটসম্যান কে বিভ্রান্ত করার উৎসব তখনও চলছিলো। বিশ্ব ক্রিকেটে দানবীয় রূপে আবির্ভাব হতে থাকা ড্যানি দলের সতীর্থদের কাছে ছিলেন এক হাসিরপাত্রও বটে।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৪৮ টেস্ট খেলেছেন, এর অর্ধেক টেস্টেই তিনি খুলতে ব্যর্থ হয়েছেন রানের খাতা। তাই সর্বাধিক ২৪ ডাকের এই খেতাব, ১৯৯৪ সালের হ্যাট্রিকের খেতাব কে ছাড়িয়ে ডাকম্যান উপাধি প্রাধান্য পেয়েছিলো অধিক সতীর্থদের কাছে। আবার এই ডাকম্যান-ই এক বিরল কীর্তি গড়েছিলন ব্যাট হাতে। ধুঁকতে থাকা কিউই দলটাকে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে তুলে টেস্ট ড্র করান ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে মধ্যাহ্ন বিরতিতেই ইংল্যান্ডের বিজয় প্রায় সুনিশ্চিত।
মাঠে থাকা নাথান অ্যাস্টেলকে সঙ্গ দেওয়ার কেউই ছিলোনা কিউই ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিলে। কিউই সাজঘরে তখন পরাজয়ের সুর বেজে উঠেছিলো। ব্যাটিং নিয়ে সতীর্থদের হাসির পাত্র ড্যানি সেদিন বিস্ময়ের জন্ম দেন। এস্টেল কে সঙ্গ দিয়ে একের পর এক বল ঠেকিয়ে দেন ইংলিশ বোলারদের। সময় পার করতে থাকেন মাঠে। একটানা তিন ঘন্টা মাঠে দাঁড়িয়ে ড্যানির সংগ্রহ দাঁড়ায় অপরাজিত ১৪ আর অ্যাস্টেল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দল কে পরাজয়ের লজ্জা থেকে বাঁচান। বিস্ময়ের জন্ম দেওয়া ড্যানি কে এরপর আর দেখা যায়নি কিউইদের হয়ে সাদা জার্সিতে। টেস্ট দল থেকে বাদ পড়লেও, ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে মনে রাখার মত কিছুই করে গিয়েছিলেন তিনি।
দশ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৪৪ ম্যাচে অংশ নিয়ে শিকার করেছেন ২৮৬ উইকেট। ব্যাটিংয়ে নগন্য একজন হয়েও মনে রাখার মতোই কিছু করে গিয়েছেন। জাতীয় দল থেকে বিদায় নিলেও ক্রিকেট থেকে নেননি। ক্রিকেটের সাথে তার যাত্রা বরঞ্চ দীর্ঘ হয়েছে। মাঠের ক্রিকেটে দর্শক কে মাতিয়ে রাখার দায়িত্ব শেষে, তিনি এবার যোগ দেন কমেন্ট্রিবক্সে বসে ক্রিকেট কে মাতিয়ে রাখার কাজে। তার রসে ভরপুর মন্তব্যে ক্রিকেট হয়েছে আরো গুরুত্ববহ ও উপভোগ্য দর্শকদের কাছে।
সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেট ধারাভাষ্যে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। মাঠের ক্রিকেটে থেকে অবসর নিয়ে মরিসন অগণিত ক্রিকেট-সম্পর্কীয় কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। টিভিএনজেড, স্কাই স্পোর্টস, ফক্স স্পোর্টস তার মধ্যে অন্যতম। স্কাই স্পোর্টসের ক্রিকেট কোম্পানি ও রেডিও স্পোর্ট প্লাটফর্মে তিনি সবমিলিয়ে কাজ করেছেন ১৩ বছর। মস্তিষ্কঝিল্লীর প্রদাহজনিত রোগ বা মেনিনজাইটিসের জন্য ‘জীবনের জন্য যুদ্ধ’ নামের একটি দাতব্য সংস্থায় কাজ করছেন। বিদ্যালয় ও ক্লাবে কোচিং কার্যক্রমে জড়িত আছেন। অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখছেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিউজিল্যান্ড বিচ ক্রিকেট দলের ব্যাটার/বোলার হিসেবে খেলছেন।
বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের বড় বিনোদনের কেন্দ্র এখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। দুনিয়াব্যাপী সাড়া জাগানো ক্রিকেটের এই সংস্করণে ড্যানি মরিসন তাঁর কণ্ঠের জাদু দিয়ে অবাধে বিচরণ করে যাচ্ছেন। আইপিএল, বিপিএল, পিএসএল, এপিএল, সিপিএল সব লীগেই তিনি নজর কেড়েছেন দর্শকদের। টসের সময় দুই অধিনায়কের সাথে খুনসুটি, পিচ রিপোর্টের সময় পিচে শুয়ে পিচের সাথে কথা বলা সবকিছুই তার জন্ম দেওয়া রীতি। আইপিএলে নারী উপস্থাপককে কোলে নিয়ে হয়েছেন হাসি-তামাশার পাত্রও। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে ড্যানি মরিসন থাকেন দর্শক চাহিদার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে। কখনো ভালবাসার পাত্র হয়েছেন, কখনো বিতর্কও ছুয়ে গেছে তাঁকে।
কমেন্ট্রিবক্সে তার অদ্ভুত সব অঙ্গাভঙ্গী পুলকিত করে টিভি স্ক্রিনের সামনে থাকা দর্শকদের। ক্রিকেটের কমেন্ট্রিতে এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি। একে একে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ধারাভাষ্যের গৎবাঁধা সকল নিয়ম। একসময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যান ধারাভাষ্যের নিখাদ বিনোদন নিউজিল্যান্ডের সাবেক তারকা ক্রিকেটার ড্যানি মরিসন। দুনিয়াব্যাপী তার ধারাভাষ্যের জনপ্রিয়তার মূল রহস্য, ম্যাচের হাওয়া অনুযায়ী তার ভঙ্গিমায় পরিবর্তন। টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সর্বদাই উত্তেজনা বিরাজমান মাঠে, গ্যালারী এবং টিভি স্ক্রিনে। সেই অনুযায়ী প্রতি মূহুর্তে নিজের মানসিকতা কে পরিবর্তন করে কন্ঠের মাধ্যমে বিনোদনের জন্ম দেন এই ধারাভাষ্যকার।
সাধারণত ক্রিকেটে ধারাভাষ্য খেলাটির আকর্ষণ বাড়ায়। রসহীন ম্যাচকেও রসে পরিপূর্ণ করতে কমেন্ট্রিবক্সে উপস্থিত বক্তাদের ভূমিকাই মূল। মৃত ম্যাচকেও জাগ্রত ও উপভোগ্য করে তোলে কমেন্ট্রি। সেই দিক দিয়ে ড্যানি একজন সফল কমেন্টেটর। একজন নির্ভেজাল ও নিরপেক্ষ কমেন্টেটরের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ড্যানি। তাই তাকে ক্রিকেটের অকৃত্রিম ও আদর্শ কর্মী বললে মোটেও ভুল হবেনা।
ম্যাচশেষে জয়ী দলের সাথে জয়োল্লাসেও মেতে উঠেন নিজ আসন ছেড়ে, নাচে-গানে হয়ে যান মাতোয়ারা। পরাজিত দলের সদস্যদেরও দেখান আলোর পথ তার বক্তব্যে। তরুণ তুর্কীরা বরারব-ই তার বক্তব্যে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। ক্রিকেটে ড্যানি মরিসন একজন অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্বও বটে।