ধৈর্যের বিজয়গাঁথা

সময়টা অক্টোবর , ২০১৫! দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল তিনটি টোয়েন্টি, পাঁচটি ওয়ানডে এবং চারটি টেস্ট ম্যাচ খেলতে ভারতে আসে। টি-টোয়েন্টি সিরিজ ২-০ ব্যবধানে অনায়াসে জিতে নিলেও, কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ওয়ানডে সিরিজে। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে জয়লাভের মাধ্যমে  ওয়ানডে সিরিজও নিজেদের করে নেয় প্রোটিয়ারা।

তখন, আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে ছিল সফরকারীরা। কিন্তু, ভারত ও ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। নিজেদের মাটিতে সীমিত ওভারের সিরিজ হারের লজ্জা নিয়েই তারা টেস্ট সিরিজে প্রতিশোধ নিতেই মাঠে নামে তাঁরা।

চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ব্যাঙ্গালুরুতে ড্র হলেও,  প্রথম টেস্টে মোহালিতে  ভারত ১০৮ রানের ব্যবধানে এবং তৃতীয় টেস্টে নাগপুরে ১২৪ রানে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সিরিজ জয় নিশ্চিত করে।

বাকি ছিল চতুর্থ টেস্ট। ডেড রাবার। ডিসেম্বর ৩, ২০১৫! দিল্লীর অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম। তখনকার ফিরোজ শাহ কোটলা।

আগের তিন ম্যাচের দুই ম্যাচে ভারতের স্পিন বিষে নীল হয়ে সিরিজ খোয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা। একে ভারতের উইকেট ছিল রীতিমত মাইন ফিল্ড, স্পিনার দের জন্য স্বর্গ।  প্রতিটি বলই যেন ছিল কেউটের একেকটা ফণা।

এরপর ভারতে ছিল রবিচন্দন অশ্বিন এবংং রবীন্দ্র জাদেজার মত বিশেষজ্ঞ স্পিনার,যাদের বিপক্ষে আগের তিনম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা রীতিমতো হাসফাস করেছে ব্যাট করতে নেমে।

অনেকটা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। এমন অবস্থায় টস ভাগ্যে বিরাট কোহলি জয়লাভ করে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন।

স্বাভাবিকভাবে দিল্লীর উইকেটে অনেক বাউন্স থাকে যা বোলারদের জন্য অনেক সহায়ক হয়, এর সাথে ডিসেম্বরের সকালের ওভারকাস্ট কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে প্রথম সেশনে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা  বেশ নিয়ন্ত্রিত বোলিং করছিল।

প্রথম সেশনে মাত্র একটি উইকেটের পতন হয়। তবে, দ্বিতীয় সেশনের শুরুর দিকেই ড্যানিয়েল পিট এবং কাইল অ্যাবোট পরপর দুই ওভারে শিখর ধাওয়ান আর চেতেশ্বর পুজারার উইকেট তুলে নিলে ভারত কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায়।

সেখান থেকে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দেন ভারতীয় অধিনায়ক কোহলি এবং রাহানে। যদিও ঐ ড্যান পিট এর  বলেই ড্যান ভিলাসের  গ্লোভসবন্দী হোন কোহলি। এরপর নামা রোহিত শর্মা, ঋদ্ধিমান সাহাদের কেউই বেশিক্ষণ টিকতে না পারায় চা বিরতির আগেই ভারত ১৩৯ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয় এ পরে।

সেখান থেকে দলকে টেনে তোলেন আজিঙ্কা রাহানে। প্রথমে জাদেজা এবং পরে অশ্বিনকে নিয়ে দুটা ম্যাচ জেতানো জুটি তৈরি করে দলকে একটা ভাল সংগ্রহ এনে দেন। দিতীয় দিনে লাঞ্চ বিরতির আগে যখন ভারত অল আউট হয়, তখন রাহানের ১২৭ রানের সুবাদে দলের রান ৩৩৪ হয়।

ভারত জানত, তাদের এই ম্যাচকে আয়ত্বে নেয়ার জন্য যথেষ্ট রান হয়ে গেছে। দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চ বিরতির পর দক্ষিণ আফ্রিকা দল যখন ব্যাটিংয়ে নামে, তখন  ভারতীয় স্পিনারদের সামনে দাড়াতেই পারেনি। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে রাহানের সংগ্রহের চেয়েও কম রান সংগ্রহ করে। রবিন্দ্র জাদেজা এবং অশ্বিন এর স্পিন তোপে মাত্র ৪৯ ওভার খেলে ১২১ রানে অল আউট হয়।

ভারত প্রথম ইনিংসে ২১৩ রানের লিড পায়। বিরাট কোহলি জানতেন এই উইকেটকে। তিনি যে দিল্লীরই ছেলে। তাই বোধহয় এত রান থাকতেও ফলো অন করিয়ে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করার ঝুঁকি নিতে চান নি।

ম্যাচের তৃতীয় এবং নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভারতের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, যতটা সম্ভব দক্ষিণ আফ্রিকাকে বল করানো, যাতে করে উইকেট আরও ভাঙে এবং পরের ইনিংসে ভারতের স্পিনারদের আরও বেশি সুবিধা হয়। সেই লক্ষ্যেই ভারত দ্বিতীয় ইনিংস কিছুটা ধীরলয়েই শুরু করে।

কিন্তু, এবারও তারা  মাত্র ৫৭ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয় এ পরে।  এবারও এই পরিস্থিতিতে দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব নেন আজিঙ্কা রাহানে।

তাকে যোগ্য সঙ্গী দেন অধিনায়ক কোহলি। দুজনের ১৫৪ রানের জুটিতে ভারতের স্কোর ও লিড দুইই অনেকদূর এগিয়ে যায়। কোহলি ৮৮ করে আউট হলেও রাহানে দ্বিতীয় ইনিংসেও ১০০ রান করার মাধ্যমে, একই টেস্টে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকানোর অনন্য এক রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেন।

তার শতকের সাথে সাথেই ভারতীয় অধিনায়ক কোহলি দলের ইনিংস ঘোষণা করেন।  ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসের স্কোর দাঁড়ায় ২৬৭-৫। এবং লিড ৪৮০! জয়ের জন্য ভারত আফ্রিকানদের ৪৮১ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয়।

তৃতীয় দিন বিকেলে ৪৮১ রানের লক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন দিল্লির মাইন ফিল্ডে ব্যাট করতে নামে, ভারতের দরকার মাত্র ১০ উইকেট।  দক্ষিণ আফ্রিকাকে দুদিনের বেশি সময় ব্যাট করতে হত। যেখানে তারা প্রথম ইনিংসে মাত্র ৫০ ওভারও পারেনি।

ক্রিজে ডিন এলগার এবং টেমবা বাভুমা যখন ওপেনিং করতে আসেন, তখনই কিছু একটা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। হ্যাঁ, তাঁদের মানসিকতায় ছিল স্পষ্ট পরিবর্তন।

দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড়, ম্যানেজমেন্টের সবাই বুঝে গিয়েছিল তাদের জন্য এই ম্যাচ জেতা একেবারে অসম্ভব। এই পিচে, ২০০ ওভারের কাছাকাছি ব্যাট করে ম্যাচ জেতা কোনো ভাবেই সম্ভব না।

তবে তারা ২০০ ওভার ব্যাট করার মানসিকতা নিয়ে শুরু করে। অপরদিকে, তাদের বিপক্ষে ছিল অশ্বিন, জাদেজার বল। বল বললে ভুলই হবে, আসলে ছোবল। আর তার সাথে ভারতীয় দর্শক। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা যেন সেদিন পণ করেছিল। তারা সকল প্রতিকূলতা কে পাশ কাটিয়ে তাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকবে। তার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি ও করে নি।

আজকালকার টি-টোয়েন্টির ধুম ধাড়াক্কা মারদাঙ্গা ক্রিকেটে সেদিন যেন দিল্লীতে অন্য কিছুই দেখা গিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিটি ব্যাটসম্যানের ব্যাট যেন ব্যাট নয়, দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এ দেয়াল এমনই যেখানে শুধু একের পর এক অশ্বিন, জাদেজার স্পিনের ছোবল এসে থেমে আটকে যাচ্ছিল। এমনকি,অনেক সময় দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান দের নিজেদের মানসিকতা থেকে বের করতে অশ্বিন জাদেজা ইচ্ছে করেও ফুলটস, হাফভলি বলও দিয়েছেন। কিন্তু, আফ্রিকান ব্যাটসম্যানরা ছিলেন নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল।

যে ব্যাটসম্যানরা ইচ্ছেমত বলকে সীমানার ওপারে আছড়ে ফেলেন, কঠিন কঠিন ইয়র্কারকে বাউন্ডারি হাঁকান, তারাও সেদিন রক্ষণাত্মক খেলা কিভাবে খেলতে হয় দেখালেন।

হালের সেরা এবি ডি ভিলিয়ার্স ,হাশিম আমলা, ফাফ ডু প্লেসি – প্রত্যেকেই পণ করেছিলেন। হ্যাঁ, ভুল পড়েননি – ভিলিয়ার্স, যিনি কি না টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত – তিনি সেদিন ভিন্ন এক অবতার ধারণ করেছিলেন।

তাদের মুখে খাবার তুলে দিলেও তারা সেদিন খাবেন না৷ হাজার ফুলটস এলেও তারা ব্যাট চালাবেনই না।  যার প্রতিফলন ছিল তাদের দ্বিতীয় ইনিংসের স্কোরকার্ড এ। ১৪৩ ওভার ব্যাট করে, ওভারপ্রতি ১ এর কম রান তুলেছিল সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকা।

বল যেমনই হোক, তাদের লক্ষ্য ছিল মাটি কামড়ে পিচে পরে থাকা। রবীন্দ্র জাদেজাকে সেদিন টানা ১৭ টা ওভার মেডেন দিয়েছিলেন আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা। রবীন্দ্র জাদেজা সেদিন ৪৬ ওভার বল করে ৩৩ টিই মেডেন পান। অশ্বিন পান ২৬ টি মেডেন।

আফ্রিকান ব্যাটসম্যান দের মধ্যে আমলা এবং ডি ভিলিয়ার্স ২৫০ এর বেশি বল খেলে সেদিন মাত্র। মাত্র ১০-এর কাছাকাছি স্ট্রাইক রেটে রান করেন। অধিনায়ক হাশিম আমলা ২৪৪ বল খেলে মাত্র ২৫ এবংং ডি ভিলিয়ার্স ২৯৭ বল খেলে মাত্র ৪৩ টি রান করেন। পরে ফাফ ডু প্লেসিস ৯৭ বল খেলে মাত্র ১০ রান করেন।

আসলে অনেক সেরা খেলোয়াড়েরা বলেন, টেস্ট ম্যাচ শুধু একটা টেস্ট খেলা না। এটা একটা খেলোয়াড় এর পরীক্ষা,পরীক্ষা টেম্পারমেন্ট, ধৈর্য এবং টেকনিকের।

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা হয়ত সেদিন ম্যাচটা ড্র করতে বা জিততে পারেননি। কিন্তু, সেদিন দিল্লীর স্পিন পিচে পঞ্চম দিনে ১৪৩ ওভার ব্যাট করার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, এটাও সম্ভব। অথচ, একই দল প্রথম ইনিংসেই সেই উইকেটে ৫০ ওভারও টিকতে পারেনি। সেজন্যই তো ম্যাড়মেড়ে, বিরক্তিকর টেস্ট ক্রিকেট ‘ইজ স্টিল দ্য বেস্ট ক্রিকেট।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link