বাংলাদেশি পেস বোলিং, অদৃশ্য থেকে দৃশ্যপটে

বছর তিনেক আগে ফিরে যাওয়া যাক। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদশের পেস বোলিং ইউনিটটা তখন অনেকটা আইসিইউতে পড়ে থাকার মতো। স্পিনারদের দৌরাত্ম্যে কালেভদ্রে কিছু ম্যাচ জিততে শুরু করলো বাংলাদেশ। ওতেই যেন অসীম তৃপ্তি। কিন্তু ম্যাচজয়ের আড়ালে যে বাংলাদেশের পেস লাইনআপ ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই কারো।

এমন দৈন্যদশায় হঠাৎ আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হলেন এবাদত হোসেন। কিউইদের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইতে দেখালেন ঝলক। সকলকে বিস্ময়ে ভাসিয়ে টেস্ট ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিলেন তিনি। 

ডেল স্টেইন, জিমি এন্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, কাগিসো রাবাদা, বুমরাহদের বিধ্বংসী বোলিংয়ে পরিচিত পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। এদের সাথে মিলিয়ে বাংলাদেশি কোনো পেসার শেষ কবে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের জন্য অস্বস্তি কিংবা ভয়ের কারণ হয়েছে তা মনে করা বেশ দুষ্করই বটে। তবে মাউন্ট মঙ্গানুইতে সেদিন রস টেইলরা খাবি খাচ্ছিলেন ৮১ বোলিং গড়ের অখ্যাত এক বাংলাদেশি বোলারের পেসে।

হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। সে টেস্টের আগে এবাদত ছিলেন আর দশটা অর্ডিনারি বোলারের মতোই। বরং আরো হতশ্রী পরিসংখ্যানে রীতিমত বাংলাদেশ দলের গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছিলেন তিনি৷ তবে ৩৭ রানে ৬ উইকেটের ঐ বোলিং ফিগারেই ক্যারিয়ারে একটা পুনর্জাগরণ ঘটান এবাদত। একই সাথে বাংলাদেশের পেস বোলিং লাইন আপকে আইসিইউ থেকে ফিরিয়ে এনে একটা পুনর্জীবন দেন তিনি। 

এবাদত হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশ পেস বোলিংয়ের নবযাত্রা শুরু। এরপর সেনা’র আরেক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে আরেক চমক। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এর আগে ১৬ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেললেও প্রত্যেকটিতেই জয়শূণ্য ছিল বাংলাদেশ।

অথচ ক’দিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গিয়েই সিরিজ জয়। আর সে সিরিজ জয়ের নেপথ্যে ছিলেন তাসকিন আহমেদ। সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে নিয়েছিলেন ৩৫ রানে ৫ উইকেট। আর এতেই সে ম্যাচে ম্যাচসেরার পুরস্কারের পাশাপাশি ম্যান অব দ্য সিরিজও তাসকিন হয়েছিলেন। 

পারফরম্যান্স গুলো যে নেহায়েতই কোনো বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না, সেটি প্রমাণ করে সে সফরেই টেস্টে দারুণ বোলিং করেছিলেন খালেদ আহমেদ। আর সীমিত ওভার ক্রিকেটে মুস্তাফিজ এই মুহূর্তে একটু অফফর্মে থাকলে সে কিন্তু প্রকৃত ম্যাচ উইনার। এর পাশাপাশি হাসান মাহমুদ ইনজুরি প্রবণ হলেও, এখন পর্যন্ত বেশ ঠিকঠাক পারফর্মই করে যাচ্ছেন তিনি।

গতির সাথে আপস না করে সুইং দিতে পারছেন স্বাচ্ছন্দেই। আবার ইকোনমিক্যাল বোলিং করে উইকেটও তুলে নিচ্ছেন। এ ছাড়া শরিফুল ইসলামও আছেন সঠিক ট্র্যাকেই। প্রয়োজনীয় সময়ে দারুণ ব্রেক থ্রু দিতে পারেন এই বাঁহাতি পেসার। সবকিছু মিলিয়ে, এটাই কি বাংলাদেশের সেরা পেস বোলিং লাইন আপ? উত্তরটা হয়তো তর্কযোগ্যই হবে। তবে পেস, সামর্থ্য, শক্তিমত্তা বিবেচনা করলে এটিই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা পেস বোলিং লাইন আপ। 

সময়ের হিসেবে আর ২৪ ঘন্টাও নেই। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশন শুরু হচ্ছে আগামীকাল। তবে বছরের হিসেবে, এই ফরম্যাটেই বড্ড বেশি নাজুক অবস্থা বাংলাদেশের। ২০২২ এ এখন পর্যন্ত ১৬ ম্যাচের ১২ টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। তবে এবারের বিশ্বকাপটা হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে।

আর এটাই বাংলাদেশের সাফল্যের কারণ হতে পারে। বিষয়টা অনেকের কাছেই অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্য যে, পেস উইকেটের স্বর্গ অজিদের দূর্গে বাংলাদেশের ভাল করার সম্ভাবনা প্রবল। অন্তত আগের দুই সেনা কান্ট্রিতে পেসারদের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। 

রাসেল ডোমিঙ্গোর সময়ে বাংলাদেশ ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরতে থাকলেও তিনি বাংলাদেশে একটি বোলিং সংস্কৃতি তৈরি করতে পেরেছেন। আগের স্পিন নির্ভর বাংলাদেশ এখন অনেকাংশেই নির্ভর হয়ে পড়েছে পেস বোলিংয়ের উপর। আর এটা পুরোপুরিভাবে হয়েছে রাসেল ডোমিঙ্গোর অধীনেই।

যদিও মিরপুরের উইকেটে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে বাংলাদেশ হারিয়েছিল ঐ স্পিন পিচেই। কিন্তু ফ্যাক্টটা হচ্ছে, মিরপুরে কবেই বা স্পোর্টিং পিচে খেলা হয়েছে। তাই সেটি বাদ দিলে ডোমিঙ্গো বরাবরই পেসারদের গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ তাঁর পরিকল্পনায় ছিল পরের সফর গুলো। বাংলাদেশ গত এক বছরে দেশের চেয়ে দেশের বাইরেই খেলেছে। সেই অনুযায়ী বাইরের কন্ডিশনে ভাল করতে পেসারদেরই ভূমিকা নিতে হতো৷ রাসেল ডোমিঙ্গো সেই পরিকল্পনাতেই এগিয়েছেন। কিন্তু ব্যর্থতার আড়ালে এগুলো সব ঢাকা পড়ে গেছে আরকি। 

এ বারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশি পেসারদের ভাল করার ব্যাপার ডোমিঙ্গো নিজেও আশাবাদী। তিনি বলেছেন, ‘গত দুই বছর ধরে ওরা অনেক উন্নতি করেছে। এবারের বিশ্বকাপে তাসকিন, এবাদত এরা প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের জন্য ভয়ানক হতে পারে। তাই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রধান অস্ত্র হবে পেস বোলিং।’

রাসেল ডোমিঙ্গোর আগেও পেস বোলিংয়ে একটা জাগরণ হয়েছিল। সেটি প্রায় চার বছর আগে। তখন অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি আর কোচ ছিলেন হাথুরুসিংহে। আর ঐ পেস বোলিংয়েই ঘরের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছিল বাংলাদেশ।

কিন্তু, সর্বনাশার শুরুটা আবার ঐ সময়েই। কারণ সে সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে আবার স্পিন পিচ স্ট্র্যাটেজিতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এতে করে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব হলেও সে সব সাফল্যের রেশ কিংবা ধারাবাহিকতা কোনোটাই দীর্ঘমেয়াদে টেকেনি। সবকিছুই ছিল সাময়িক। আর সে কারণেই সে সময় পেসারদের অগ্রযাত্রা আঁটকে যায়। এখানে অবশ্য সে সময়ের কিছু চিত্র বর্ণনা করা যেতে পারে।

মিরপুরে হওয়া ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে টেস্টে শেষ ইনিংসে বাংলাদেশের পেসাররা কোনো বল করার সুযোগই পেয়েছিল না। আর পুরো টেস্টে মাত্র ৩১ ওভার জুটেছিলে পেসারদের জন্য। এ চিত্রটা আরো ভয়ানক ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। অস্ট্রেলিয়া সিরিজে মাত্র ১৪.৫ শতাংশ বল করেছিল বাংলাদেশি পেসাররা।

আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে মাত্র ২ শতাংশ বল জুটেছিল পেসারদের ভাগ্যে। শুধু ভেবে দেখুন, পেসারদের জন্য দলে টিকে থাকা তখন কতটা কঠিন ছিল। আর ক্রিকেটের সেরা অনুশীলনটা তো ম্যাচ খেলার মাধ্যমে হয়। সে হিসেবে পেসাররা তখন ম্যাচই খেলতে পারতেন না। তাহলে তাদের কাছে দারুণ প্রত্যাশা রাখা আর পাহাড়সহ চাপ ঠেলে দেওয়া তো একই কথা হয়ে দাঁড়ায়।

তবে সেই দশা থেকে নিজেদের পুনরুত্থান বাংলাদেশি পেসাররা নিজেরাই করেছিল। ২০২০ সালে দুটি ঘরোয়া কাপ অনুষ্ঠিত হয়। একটি বিসিবি কাপ আরেকটি বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ। সেখানেই নিজেদের প্রমাণ করেন পেসাররা৷ বিসিবি কাপের সেরা ১০ উইকেটশিকারী বোলারের মধ্যে ৮ জনই ছিলেন পেসার।

আর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে সে সংখ্যাটা ছিল ৯। মূলত কোভিড পরিস্থিতিতে মাঠের বাইরে থেকেও নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিলেন তাসকিন, এবাদতরা। ফিটনেস নিয়ে তো তাসকিনের কঠোর শ্রমের ব্যাপারটি কারো কাছেই অজানা নয়। আর এতে হঠাৎ করেই পেস বোলিং লাইন আপটা সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। বিসিবিও সুনজর দেওয়া শুরু করে। নির্দিষ্ট করে পেসারদের কন্ডিশনিং ক্যাম্পের আয়োজন করে। এর সুফলও পায় বিসিবি। সেনা কান্ট্রিতে কিউদের বিপক্ষে ৮ উইকেটর জয় আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়- দুটিই এসেছিল পেসারদের কল্যাণে৷ 

তাসকিন, এবাদত, মুস্তাফিজ, হাসানদের নিয়ে গড়া পেস বোলিং লাইনআপের গড় বয়সটা খুব বেশি নয়। এক বাক্যে তরুণই বলা যায়। আর এটাই বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। কারণ এদের নিয়ে লম্বা এক পথ পাড়ি দিতে পারবে বাংলাদেশ শুধু দরকার পরিচর্যা। অঙ্কুরেই যেন বিনষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পেসারদের সাধারণত ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয় না৷ সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটে তাদের খেলানো উচিত। 

জহির খানের পরে ভারতের মতো ক্রিকেটার সমৃদ্ধ দেশও আন্তর্জাতিক মানের পেসারের খোঁজে দিশেহারা হয়েছে। কিন্তু সেই ভারতই স্পিন নির্ভর থেকে হয়েছে পেস বোলিং জায়ান্ট এক দল। স্পিন পিচ থেকে তাঁরাও আস্তে সঁরে আসা শুরু করেছে। সেই পথে বাংলাদেশও অবশ্য হাঁটছে। এবারের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট ডিউক বল দিয়ে খেলা হচ্ছে।

পেসাররাও নাভি শ্বাস এক পরিস্থিতি থেকে উঠে আসছে। পিচ নিয়ে খুশি ক্রিকেটাররাও। এভাবেই তো দিন বদলের গল্প উঠে আসবে। যদিও এমন সিদ্ধান্ত কিংবা পেসারদের জন্য আবহ বিসিবির আগেই করা উচিত ছিল। হয়তো পেসারদের প্রতি অনাস্থা থেকেই সে কাজ আটকে ছিল। তবে দেরিতে হলেও সুবুদ্ধির উদয় ঘটেছে। বিশ্ব ক্রিকেটের সাথে তাল মিলিয়ে এমন সব সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হোক, সেটাই তো সবার একমাত্র কাম্য।  

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link