বিরাটকাব্যের শাস্ত্রীয় বয়ান

বিরাট কোহলির অতিমানবীয় এক ইনিংসে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রতিশোধের ম্যাচে জয় পেয়েছে ভারত। ম্যাচের বড় সময়জুড়ে পাকিস্তানের আধিপত্য থাকলেও কোহলির ৮৩ রানের ইনিংসে বিফলে গেছে রউফ-শাহীনদের সকল প্রচেষ্টা। অথচ কয়েকদিন আগেও বিরাটের পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনায় মেতেছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম। ম্যাচের শেষে তাই সংবাদমাধ্যমে সমালোচকদের একহাত নিয়েছেন ভারতের সাবেক কোচ রবি শাস্ত্রী। রবি শাস্ত্রীর বয়ানেই হোক বিরাটের অনবদ্য ইনিংসের স্তুতিগাথা। 

টি টোয়েন্টি ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ইনিংস দেখার পর আমি একটুও আশ্চর্য হইনি। আমি বরং অপেক্ষাতেই ছিলাম এমন কিছুর জন্য। আমি জানতাম অস্ট্রেলিয়াতেই সে সকল সমালোচনার জবাব দেবে। এখানকার পিচ, কন্ডিশন এবং বিরাটের আগের রেকর্ড – সবকিছুই তাঁর পক্ষেই কথা বলবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে বড় মূর্হুতে বিরাট সবসময়ই জ্বলে উঠেছে। আর বড় ম্যাচেই বড় তারকাদের সেরাটা পাওয়া যায়। 

আমি কিছুটা আবেগী হয়ে উঠেছিলাম। আমি দেখেছি গত কয়েক বছর ধরে সে কিসের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশের মানুষের মনে রাখার ক্ষমতা অনেকটা গোল্ডফিশের মতো। আমরা বলি বিরাটই ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার। আবার দুই মিনিট পরই ভোজবাজির মতো বদলে যাই। কোহলি জানে আমি এ নিয়ে কেমন অনুভব করি। আমিও জানি কোহলি কি ভাবে।

এ ম্যাচে অনেকটা দেজা ভ্যু ঘটেছে। ১৯৮৫ সালে এমসিজিতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচেই আমরা পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমরাই জিতেছিলাম সেদিন। এখন যদি এমসিজিতে ফাইনালে আবারো মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান? তাহলেও আমরাই জিতবো। 

আমার এত বছরের ক্রিকেটীয় জীবনে বহু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছি। হারিস রউফকে মারা বিরাটের ওই দুইটি ছয় যেকোনো ভারতীয় ব্যাটারের খেলা সেরা শট। একমাত্র তুলনা হতে পারে ২০০৩ বিশ্বকাপে সেঞ্চুরিয়নে শোয়েব আকতারকে হাঁকানো শচীনের ছক্কাটার সাথে। আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা দুই ক্রিকেটার তাঁরা। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনূস, শোয়েব আকতারদের সামলে সাদা বলের ক্রিকেটে অসাধারন এক ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন শচীন। আর তারপরেই থাকবে কোহলির এই ইনিংস। এই দুই ইনিংসেই আমরা দেখেছি কিভাবে কোয়ালিটি ফার্স্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে ব্যাট করতে হয়। 

কোহলির এই ইনিংসে বুঝতে গেলে কিছুটা পেছনে ফিরে তাঁর বিশ্রামের সময়টাতে ফিরে যেতে হবে। কেবল আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাওয়া নয়, করোনা মহামারী বহু ক্রিকেটারেরই মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছে।

ভাগ্যিস ক্রিকেট টাকা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে। কিন্তু টানা মাসের পর মাস বায়োবাবলে থাকা অনেক কঠিন। ভ্রমণক্লান্তি, একাকী রুমে আটকে থাকা, সবসময় একা থাকা এবং সবকিছু সত্ত্বেও সবসময় পারফর্ম করার চাপ নিয়ে ক্রিকেট খেলাটা কঠিন।

কেবল কোহলিই নয়, বিশ্বজুড়ে অনেক ক্রিকেটারের মাঝেই এই প্রভাব পড়তে দেখেছি আমি। সবচেয়ে বড় উদাহরণ বেন স্টোকস, সে নিজেই তাঁর অভিজ্ঞতা বলেছে। আমি তাঁকে সম্মান করি, সে নিজের অভিজ্ঞতা সবাইকে জানিয়েছে, সময় নিয়েছে ফিরে আসতে। আমি তখনই বলেছিলাম এটা কেবলই শুরু। এরপর যখন কোহলিকে যখন আমি আইপিএলে ভুগতে দেখি, তখনই বুঝেছিলাম ওর বিরতি দরকার। সবকিছু আগে আমি তো একজন ডাক্তারের ছেলে, নাকি!

সে একমাস সময় পেয়েছিল নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার। যখন সে এশিয়া কাপ খেলতে আসে, সত্যি বলতে আমি তাঁর টেকনিক কিংবা ফুটওয়ার্ক নিয়ে খুব একটা চিন্তা করিনি। আমি কেবল ওর বডি ল্যাংগুয়েজ দেখছিলাম। আমি ওর মাঝে সেই ধীরস্থির এবং নীরবতা দেখছিলাম।

জানতাম সে ফিরে আসবেই আর পাকিস্তানের বিপক্ষে সে সেটাই করে দেখিয়েছে। আমি হার্দিক পান্ডিয়ার নাম নেবো, ও বিরাটকে সাহায্য করেছে সঠিক কাজটা করতে। যখন ২১ বলে ১১ রানে ছিল বিরাট, তখন নিশ্চিতভাবেই চাপে ছিল সে। হার্দিক দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেছে। ক্রিকেট খুবই একাকী এক খেলা, বাইশ গজে আপনার একমাত্র সঙ্গী ননস্ট্রাইক প্রান্তে থাকা ব্যাটসম্যান। 

হার্দিক অনবদ্য খেলেছে, একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নের মতো। ম্যাচের ওই পরিস্থিতিতে এমন কাউকে দরকার যে কিনা চাপটা কাটিয়ে উঠতে জানে। কানের কাছে এমন কিছু বলতে জানে যা কিনা সাহস জোগাবে। আমি হার্দিককে অনেকদিন ধরেই চিনি, জানি ও পার্টনারকে সেটাই বলবে যেটা বলা দরকার। একই কথা খাটে বিরাটের ক্ষেত্রেও। 

আর এত চাপের মুখে কি দারুণ ব্যাটিং-ই না করলেন এই দুইজন। ম্যাচ জিততে তাঁদের সামলাতে হয়েছে পাকিস্তানি পেসারদের যারা কিনা জোরে বল করতে জানেন, বিধ্বংসী এবং নিজেদের কাজে ভীষণ দক্ষ। আমরা দেখছিলাম মাঝে হার্দিক বড় শট খেলতে পারছে না। তখন বিরাটকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। 

কেবলমাত্র মানসিক প্রশান্তিতে থাকা ব্যাটারই ওরকম ব্যাটিং করতে পারবে, যেটা বিরাট শেষ পাঁচ ওভারে করে দেখিয়েছে। মাসখানেকের বিরতিটা ওকে যেন পুর্নজীবন দান করেছে। পরিশীলিত মনে সে দেখিয়েছে কি করে ক্রিকেটমাঠে ব্যাটিংটা করতে হয়।

বর্তমানে টি টোয়েন্টিতে আপনাকে ম্যাচের দাবি মেনে নিয়ে ব্যাটিং করতে হবে। সে নিজেকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছিল। বিরাটের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের আট বছর পেরোতে চললো। আমি অন্য তরুণ ক্রিকেটারদের্ব পছন্দ করি। কিন্তু আমি কোচ এবং সে অধিনায়ক – সেই সময়টা থেকেই আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়েছে। 

কোচ হিসেবে শুরুর দিকে শিরোপার পেছনে ছোটার কথা আমার চিন্তাতেই ছিল না। কিন্তু দিনশেষে ক্রিকেট আপনাকে পরিণত করে তুলবে। চলার পথে আপনি ভুল করবেন এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই আপনাকে পথ চলতে হবে। নানা চাপের মূহুর্তে আপনার চরিত্রের নানা দিক উন্মোচিত হবে। তাঁর মাঝে ব্যাপারটা ছিল।

কোচ হিসেবে নিযুক্ত হবার সময়ে আমার খানিকটা ধারণা ছিল আমরা গত পাঁচ বছরে টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠবো, হয়তো কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে শিরোপা জিততে পারবো না। আমি নিজেকে কিছুটা খুঁজে পাই বিরাটের মাঝে। ক্যারিয়ার শুরু করেছি দশ নম্বরে ব্যাটিং এ নেমে, এরপর যতটুকু অর্জন করেছি তাতে আমি গর্বিত। ক্রিকেটে বিরাট আমার চাইতে বড় প্রতিভা নিঃসন্দেহে, আমি বলেছি ক্রিকেটীয় চরিত্রের দিক থেকে। 

গত কয়েক বছরে নানা ঝড়ঝাপটার মাঝে দিয়ে গেলেও আমি জানতাম সে ফিরে আসবেই। আমার দৃষ্টিতে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচটা ছিল টি টোয়েন্টি ইতিহাসের সেরা ম্যাচ। প্রথমবারের মতো ক্ল্যাসিক টেস্ট ম্যাচ দেখার অনুভূতি হচ্ছিল আমার। হারিসকে মারা সেই দুই ছক্কা আমার মনে থাকবে বহুদিন। এই ইনিংস বিরাটকে আরো আত্নবিশ্বাসী করে তুলবে, বুঝতে সাহায্য করবে সে কি করতে সক্ষম। 

বিরাটের পরবর্তী লক্ষ্য কি? আমার কোনো প্রত্যাশা নেই, তাঁকে জীবনটা উপভোগ করতে দিন। সংবাদমাধ্যম এবং সমালোচকরা অনেক চাপ ইতোমধ্যেই দিয়েছেন তাঁর উপর এবং সে দেখিয়ে দিয়েছে সে কি করতে সক্ষম। সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছে, তাই না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link