অলৌকিক বলবেন নাকি অবিশ্বাস্য? নাটকীয়তার চূড়ান্ত মঞ্চায়ন হলো অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। এমন ম্যাচ যে ক্রিকেট বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি চোখ বন্ধ করেই বলে নেওয়া যায়। একটা দল হারতে থাকা ম্যাচে ফিরে জিতে উল্লাস করতে থাকা অবস্থায় আম্পায়ারের নো বলের ঘোষণা। সব খেলোয়াড়রা মাঠের বাইরে, মাঠকর্মীরাও পরিচর্যার জন্য মাঠে প্রবেশ করেছে। স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটার ব্লেসিং মুজারাবানি প্যাড-গ্লাভস খুলে হতাশ হয়ে বসে আছেন ডাগ আউটে।
ঠিক এমন সময়ে দৃশ্যপটে হাজির থার্ড আম্পায়ার ক্রিস গ্যাফানি। উইকেট কিপার নুরুল হাসান সোহান বল স্ট্যাম্পের আগে থেকে ধরে ফেলায় তিনি নো বলের ঘোষণা দিলেন। মাঠের বাইরে থাকা খেলোয়াড়েরা হতবাক, দর্শকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর মাঠের ভেতরে থাকা মাঠ কর্মীরা স্তম্ভিত। হুড়মুড়িয়ে মাঠের বাইরে গেলেন তাঁরা।
খেলোয়াড়েরাও অনেকটা নার্ভাসনেস নিয়ে প্রবেশ করলেন মাঠে। শেষ বলে যে মাত্র ৪ রানের দরকার। ব্যাটের কানায় গেলে পিন-পয়েন্ট ইয়র্কার বলেও চার হওয়ার ঘটনা অহরহ। না মোসাদ্দেক সৈকত তেমন কিছু হতে দেননি। ফুল লেংথের বল সজোরে হাঁকিয়েও মিস করে গেলেন ব্লেসিং মুজারাবানি। আর এবার ঠিকঠাক ভাবে উইকেটের পেছন থেকেই বল ধরলেন নুরুল হাসান সোহান। হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো টাইগাররা। অনেকক্ষণ পর শ্বাস নেয়ার সুযোগ পেল সমর্থকেরা।
তবে, এতসব নাটকীয়তার পিছনে রয়েছে আরো এক অবিশ্বাস্য গল্প। হ্যাঁ, দারুণ এক রানআউট, দুর্দান্ত এক ফিল্ডিংয়ের প্রদর্শনী। বলা যায় যে রানআউটেই পাল্টে গেছে ম্যাচের ভাগ্য। যে আগুনে থ্রোতে জয়ের বরমাল্য গতিপথ পাল্টে আফ্রিকা থেকে ইউটার্ন নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার, বাংলাদেশের দিকে।
১৮ ওভার, ১২ বলে জয়ের জন্য জিম্বাবুয়ের দরকার ২৬ রান। এমন সময় বল আসলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। উইকেটে দুই সেট ব্যাটার শন উইলিয়ামস ও রায়ান বার্ল। এ দুজনের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ম্যাচ হারের ক্ষণ গুনছেন টাইগার সমর্থকরা। প্রথম বলে রায়ান বার্ল রান নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন শন উইলিয়ামসকে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে ডাবল ও এক্সট্রা কাভারের উপর চার মেরে শেষ নয় বলে দলের লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনলেন ১৯ রানে।
তার আগের বলেই স্ট্যাম্পে বল দিয়ে চার খাওয়া সাকিব এবার বল করলেন স্ট্যাম্পের বাইরে। আলতো টোকায় সাকিবের ডানে বল ঠেলে দিয়ে স্ট্রাইক পরিবর্তন করতে চাইলেন তিনি। যতটা দূরে পাঠাতে চাইলেন বলকে ঠিক গেল না। তবুও ভো-দৌড় দিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। ম্যাচের এই অবস্থায় এক রানটাই বা কম কিসে । সাকিব দৌড়ে গিয়ে বল তুলে নিলেন, স্ট্যাম্পের দিকে ঘুরলেন আর এমন এক কর্নার থেকে বল থ্রো করলেন যেখানে কেবল একটাই স্ট্যাম্প দেখা যায়।
ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। স্ট্যাম্পে লাগলেই আউট, ম্যাচ ঘুরে যাবে বাংলাদেশ এর দিকে। মাঠে থাকা খেলোয়াড়, মাঠ ও মাঠের বাইরে টিভির সামনে থাকা দর্শকদের পৃথিবী মুহুর্তের জন্য থমকে গেল। সাকিব আল হাসানের থ্রো সরাসরি গিয়ে আঘাত হানলো স্ট্যাম্পে। বিদ্যুতের চমকের মতো লাফিয়ে উঠলো টাইগার সমর্থেকরা।আউট হয়ে গেলেন শন উইলিয়ামস। ম্যাচে ফিরে আসলো বাংলাদেশ। শেষদিকের নাটকীয়তার ম্যাচ জিতে নিলো তিন রানে।
ব্যাট হাতে সেট হয়েও আউট, বল হাতে কোনো উইকেট না পাওয়া কিংবা অধিনায়ক হিসেবেও কিছু সিদ্ধান্ত বিপরীতে যাওয়ার কারণে সমালোচকেরা প্রস্তুত হচ্ছিলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে নিয়ে সমালোচনার ফুলঝুড়ি ছোটাতে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহানায়ক সাকিব ওই সব সমালোচকদের চুপ করিয়ে দিলেন এক রানআউটে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে নিয়েও বিশ্বকাপেও কক্ষপথে ফেরালেন টিম টাইগারদের।
ম্যাচ শেষে সাকিব আল হাসান বলেন, ‘আমি শেষ বলের সময় খুবই নার্ভাস ছিলাম। মোসাদ্দেক যদিও আমাকে আশ্বস্ত করছিলো তবুও আমার মধ্যে নার্ভাসনেস চলে এসেছিলো। এমন ম্যাচ আমি আগে কখনোই দেখিনি। যে কারো জয়ের সুযোগ ছিলো ম্যাচে। আমরা ভাগ্যবান আমরা জয়ী।’
সাকিব আল হাসানের মতো কঠিন মানসিকতার খেলোয়াড় যেখানে নার্ভাস হয়ে যান, সাধারণ সমর্থেকরা তো নস্যি। তাইতো সাকিব আল হাসানরা চ্যাম্পিয়ন। এমন মুহূর্তে নার্ভাস হয়েও ব্যাট হোক বলে কিংবা ফিল্ডিং দিয়ে হলেও দলকে এগিয়ে নিয়ে যান।