ইফ আই ক্যান, ইউ ক্যান!

৭ অক্টোবর ২০০০, কেনিয়ার নাইরোবিতে তখনকার আইসিসি নকআউট ট্রফির (এখন চাম্পিয়ন্স ট্রফি) কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া। কয়েকদিন আগেই কুখ্যাত ম‍্যাচ গড়াপেটা কাণ্ডে জর্জরিত ভারতকে দুঃস্বপ্নের বেড়াজাল কাটিয়ে নতুন রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার ব্রতে ব্রতী একজন দামাল, অকুতোভয় বাঙালি।

অভিজ্ঞ সাথীদের সাথে কয়েকজন তরুণ এই লড়াইয়ের সঙ্গী। সেরকমই একজন তরুণ বাঁহাতি অলরাউন্ডার, যিনি কিনা কয়েকমাস আগেই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেছেন, আগের ম‍্যাচে অভিষেক হয়েছে্ স্বাগতিক কেনিয়ার সাথে। সেই ম‍্যাচে শুধু বল হাতে মাত্র চার ওভার করবার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু বিশ্বকে জানাতে পরের ওই গুরুত্বপূর্ণ ম‍্যাচকেই বেছে নিয়েছিলেন।

টসে জিতে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি স্টিভ ওয়াহ যখন ভারতকে ব‍্যাট করতে পাঠালো তখন বিশ্বের সেরা দুই সীমিত ওপেনারের ভালো শুরুর পরও যখন মাঝ রাস্তায় খেই হারিয়ে ফেলবার মুখে তখন নিজেকে মেলে ধরলো সেই তরুণ বাঁহাতি অলরাউন্ডার। ম‍্যাকগ্রা, ব্রেট লি, গিলেস্পির মতো বোলারদের বিরুদ্ধে একের পর এক অসাধারণ সব শট যখন বাউন্ডারিতে আছড়ে পড়ছিল, প‍্যাভিলিয়নে বসে হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন সেই বাঙালি, হীরা চিনতে তো তার ভুল হয়নি, ভুল হওয়ার কথাও নয়। আর সেইদিন হতেই শুরু হয়েছিল নব‍্য ভারতীয় দলের বিজয় পথ।

২০ মার্চ, ২০১১। চেন্নাইতে একদিনের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের শেষ ম‍্যাচে এক ট‍্যাকটিকালি অসাধারণ উইকেটরক্ষক অধিনায়কের অধিনায়কত্বে ভারতের মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেদিনের সেই তরুণ বাঁহাতি আজ ভারতীয় সীমিত দলের মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যেই ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের বিশ্বকাপ জয়ের অন‍্যতম নায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ঘরের মাটিতে এই বিশ্বকাপেও ব‍্যাটে বলে অসাধারণ পারফরম্যান্স দিচ্ছেন। এই বর্নিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম‍্যাচও তাঁর ব‍্যাতিক্রম নয়। সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এমন সময় বসে পড়লেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অশুভ সংকেতের ইঙ্গিত মনে হচ্ছে।

‌দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডে খেলতে গিয়ে কাশির সঙ্গে রক্তপাত। গলা খাঁকারির কাশির সঙ্গে হোটেলের ওয়াশবেসিনে রক্ত দেখে খানিকটা উচাটনও হয়েছিলেন,পাত্তা দেননি। কিন্তু ক্রমশ দেখছিলেন, রাতে ঘুম আসছে না। সিঙ্গলসকে দৌঁড়ে দুই করতে গিয়ে হাঁফ ধরছে অনবরত।।হাঁ করে বাতাস গেলার চেষ্টা করতে হচ্ছে। তখনও তোয়াক্কা করেননি। হাজার হোক, সামনে বিশ্বকাপ। তা–ও দেশের মাটিতে। কিন্তু বিশ্বকাপের সাতটা সপ্তাহ কেটেছিল অসহ্য শারীরিক কষ্টে। রক্তবমি, শ্বাসকষ্ট আর অনিদ্রায়।

যাই হোক সেই ম‍্যাচেও সেঞ্চুরিসহ দুই উইকেট নিয়েছিলেন। আর প্রতিযোগিতার শেষে ভারত দ্বিতীয় বারের জন্য ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২৮ বছর পর নিজেদের কবজায় এনেছিল এবং ওই প্রতিযোগিতার সেরা ক্রিকেটার হয়েছিল ওই বাঁ-হাতি অলরাউন্ডার। কিন্তু বিশ্বকাপের পরই সেই অশুভ সংকেত সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল, যেই কারনে আধুনিক যুগের অন‍্যতম সেরা সীমিত ক্রিকেটারের ক‍্যারিয়ারের শেষের শুরুর রাস্তা দেখিয়েছিল যা থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেননি বিক্ষিপ্ত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া।

জন্মেছিলেন চন্ডিগড়ের এক শিখ পরিবারে, ১৯৮১ সালে। বাবা ছিলেন একজন ভারতীয় ক্রিকেটের ধূমকেতু, ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল মাত্র সপ্তম ম্যাচেই। নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের ভার তাই চাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের উপর। ছেলেকে ক্রিকেটার বানাতে এতটাই উঠে পড়ে লেগেছিলেন সেই ক্রিকেটারের বাবা যে ছেলেটির অন‍্য খেলাধুলার শখকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল।

অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় রোলার স্কেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতে আনলেও নাকি সে পদক ঘরে উঠতে দেননি, পদক বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেন পিতা। সেই ছেলে যে বাবার স্বপ্নপূরণে নিজেকেও সঁপে দেবেনা এতে কোনো দ্বি-মত থাকবার কথা নয়।

১৯৯৯ সালের কুচবিহার ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বিহার আর পাঞ্জাব। প্রথমে ব্যাট করে বিহার তুলেছিল ৩৫৭ রান। জবাবে পাঞ্জাব কত করেছিল সেটা এখানে উহ্যই থাকুক, তিনে ব্যাট করতে নেমে ওই তরুণ একাই করেছিলেন ৩৫৮ রান। ‘বড় মঞ্চের বড় খেলোয়াড়’ – এমন ভবিষ্যত নিয়তি যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল জামশেদপুরের সে মাঠেই। ভারতীয় ক্রিকেটের যুবরাজ  হওয়ার শুরু তখন থেকেই।

বাইশ গজে খুব কম দৃশ‍্যই আছে যা যুবরাজের ফ্রি-ফ্লোয়িং ব‍্যাটিংয়ের থেকে সুন্দর। তর্কাতিত ভাবেই সাদা বলের ক্রিকেটের অন‍্যতম সেরা ম‍্যাচ-উইনার তিনি। ওই অপরূপ কভার ড্রাইভ, পয়েন্টে অসাধারণ কাট কিংবা মিড উইকেটের উপর দিয়ে অনায়াসেই মারা ড্রপ কিক গুলো সারাজীবন আমাদের মনের মনিকোঠায় আবদ্ধ থেকে যাবে।

আর মনোমুগ্ধকর বড় বড় শট গুলো যেকোনো বোলারদের কাছে দু:স্বপ্ন। আর গোল্ডেন আর্মের কথা তো সবাই জানে। নিজেকে শুধু একজন পার্টটাইমার হিসেবেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, একটা সময় ভারতীয় দল তাকে প্রায় ফুলটাইমার হিসেবেই ব‍্যাবহার করেছে এবং তিনি তার পারফরম্যান্স দিয়ে তা পুষিয়েও দিয়েছেন প্রবলভাবে। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেই সময় আলোচনা হতো যুবরাজ-কাইফের ফিল্ডিং জুটির । পয়েন্টে যুবরাজ সিং এবং কভারে মোহাম্মদ কাইফের ফিল্ডিংয়ের জুটি মিথে পরিনত হয়েছিল।

ক্রিকেট ও জীবনের ঘাত–প্রতিঘাত, চড়াই–উৎরাই, খাদের ধারে গিয়েও ফিরে আসা, একদিকে চোট–আঘাতে টিম থেকে বাদ পড়া, তারপরে আবার রাজার মতো ফিরে আসা- পুরোটাই রংচংয়ে এবং নাগরদোলার মতো জীবন তাঁর। যুবরাজ সিংয়ের জীবনের চিত্রনাট্য লেখার সময় ওপরওয়ালা সম্ভবত তাঁর অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর মূহুর্তে ছিলেন।

তাঁর জীবন আসলে এক জীবনযুদ্ধের কাহিনী। এক মুহূর্তে বাস্তবকে অস্বীকার করতে চেয়ে পরমুহূর্তে তাকে মেনে নেওয়ার কাহিনী। সে কাহিনী বুকের জোরালো খাঁচার কাহিনী। সে কাহিনী আগামীর লড়াইয়ের কাহিনীও বটে। জীবনের রূপকথাও তো রোল মডেল চায়! বারবার বলতে চাই – ‘ইফ আই ক‍্যান, ইউ ক‍্যান!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link