ইউরো ২০২০ আসরে ঘরের মাঠে শিরোপা থেকে হাতছোঁয়া দূরত্বে ফিরতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে। জিয়ানলুইজি ডোনারুম্মার বীরত্ব কিংবা ইংল্যান্ডের ফুটবলাররা স্নায়ুচাপে টাইব্রেকারে তিনটি পেনাল্টি মিস না করলে ইংল্যান্ডের ৫৫ বছরের শিরোপাখরার অবসান ঘটতো সেবারই। কিন্তু সেবার পারেনি ইংরেজরা, ‘ইটস কামিং হোম’ এর বদলে শিরোপা সেবার গিয়েছিল ইতালিতে।
তবে শিরোপা না জিততে পারলেও গ্যারেথ সাউথগেটের অধীনে চমৎকার ফুটবল খেলেছে তাঁরা। ইউরোতে টানা ৪৮০ মিনিট নিজেদের গোলবার অক্ষত রেখেছিল তাঁরা। কেবল তাই নয়, রাশিয়া বিশ্বকাপেও দুর্দান্ত শুরু করেছিল সাউথগেটের শিষ্যরা। কিন্তু সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায় ঘন্টা বাজে তাঁদের। ইংল্যান্ড দলটা প্রতিবারই শিরোপার খুব কাছে যাচ্ছে, কিন্তু শেষমূহুর্তে শিরোপা ফস্কে যাচ্ছে। তবে এবারের বিশ্বকাপে পূর্বের তুলনায় খানিকটা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দল নিয়েই যাচ্ছেন সাউথগেট। সুতরাং স্বপ্নটা দেখতেই পারেন ইংল্যান্ডের সমর্থকরা।
ইংল্যান্ড দলে প্রতিভাবান সব তরুণ ফুটবলারের ছড়াছড়ি। গোলবারের নিচে এভারটনের জর্ডান পিকফোর্ডের দাঁড়ানোর সম্ভাবনাই বেশি। যদিও তাঁর সাম্প্রতিক ফর্ম তেমন সুবিধের নয়। বরং পারফরম্যান্সের বিচারে নিউক্যাসলের নিক পোপ কিংবা আর্সেনালের অ্যারন রামসডালের সুযোগ পাবার কথা। তবে বিশ্বকাপের মাঝে সাউথগেট চাইবেন নিজের পুরনো সেনানীর উপরই আস্থা রাখার। রাইটব্যাক পজিশনে ম্যানসিটির কাইল ওয়াকার নিশ্চিইভাবেই শুরুর একাদশে থাকবেন। ভার্সেটাইল এই ডিফেন্ডারের সবচেয়ে বড় গুণ হলো ডিফেন্সের সব পজিশনেই খেলতে পারেন সমানতালে।
তিনি সেন্টারব্যাক হিসেবে মাঝখানে সরে আসলে রাইটব্যাক হিসেবে তাঁর জায়গা নিতে প্রস্তুত রয়েছেন লিভারপুলের ট্রেন্ট আলেক্সজান্ডার আর্নল্ড এবং নিউক্যাসলের কিয়েরান ট্রিপিয়ার। সেন্টারব্যাক হিসেবে জন স্টোন্সের সাথে জুটি বাঁধবেন এরিক ডায়ার এবং হ্যারি ম্যাগুয়ারের মাঝে একজন। এছাড়া বেঞ্চে থাকবেন বেন হোয়াইট, কনর কৌডির মতো ফুটবলার। রক্ষণের বাঁ পাশটা সামলানোর দায়িত্ব থাকবে লুক শ’র কাঁধে।
মিডফিল্ডে ডাবল পিভট রোলে জুটি বাঁধবেন ওয়েস্ট হ্যাম অধিনায়ক ডেক্লান রাইস এবং বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের জুড বেলিংহ্যাম। মিডফিল্ডের এই দুজন যেন এঁকে অন্যের পরিপুরক। রাইস ইংল্যান্ড তো বটেই, বর্তমানে বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজন। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভেস্তে দিতে তিনি অতুলনীয়। তাঁর সহযোগী তরুণ বেলিংহাম খানিকটা আক্রমণাত্নক ভূমিকাতেই খেলতে পছন্দ করেন। মাঠটাকে বড় করে দ্রুত পাস খেলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স গুঁড়িয়ে দিতেই বেশি ভালোবাসেন তিনি।
গোলের রাস্তাটাও ভালোই চেনেন, মাঝমাঠে খেলেও এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে চার গোল রয়েছে তাঁর। তাঁদের বিকল্প হিসেবে বেঞ্চে বসবেন অভিজ্ঞ জর্ডান হেন্ডারসন, ক্যালভিন ফিলিপস, কনর গ্যালাঘাররা। এই দুজনের সামনে আক্রমণাত্নক মিডফিল্ডার হিসেবে দেখা যাবে চেলসির ম্যাসন মাউন্টকে। বলা যায় ইংল্যান্ডের প্রায় প্রতিটি আক্রমণের সূচনাই হবে মাউন্টের পা থেকে। তাঁর বিকল্প হিসেবে দলে থাকা লেস্টার সিটির জেমস ম্যাডিসনও আছেন দারুণ ফর্মে।
আক্রমণভাগে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলবেন কাপ্তান হ্যারি কেইন। প্রতিবারের মতো এবারো গোলের জন্য তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকবে ইংলিশরা। তাঁর দুইপাশে উইংগার হিসেবে ফিল ফোডেন এবং রাহিম স্টার্লিংয়ের সুযোগ পাবার সম্ভাবনাই বেশি। আর্সেনালের হয়ে বুকায়ো সাকা দুরন্ত ফর্মে থাকলেও কোচ হয়তো তাঁকে ম্যাচের শেষের দিকে বদলি হিসেবে ব্যবহার করতেই বেশি পছন্দ করবেন। একই কথা খাটে মার্কাস রাশফোর্ডের ক্ষেত্রেও। আর প্রথম পছন্দের কারো ইনজুরি ঘটলে কপাল খুলে যেতে পারে নিউক্যাসলের ক্যালাম উইলসনের।
শিরোপার অন্যতম দাবিদার হলেও ইংল্যান্ড দলেও রয়েছে নানা দুর্বলতা। বিশেষ করে শেষ মূহুর্তে দুই ফুলব্যাক রিস জেমস এবং জেমস চিলওয়েলের কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিয়েছে ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগকে। তাছাড়া গোলবারের নিচে পিকফোর্ডও ভুগছেন ফর্মহীনতায়। সবমিলিয়ে নকআউট পর্বে ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগের মার খেয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। তাছাড়া ইংল্যান্ড দলে প্রতিভাবান এবং তারকা ফুটবলারের ছড়াছড়ি থাকলেও তাঁদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বেশ অভাব রয়েছে। অনেক সময়ই চাপের মুখে দলের মাঝে ছন্নছাড়া পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে দেখা যায়।
এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মূল তারকা অধিনায়ক হ্যারি কেইন হলেও এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন ফিল ফোডেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই জাতীয় দলকে জিতিয়েছিলেন অনূর্ধব-১৭ বিশ্বকাপের শিরোপা। ২০২০ ইউরোর ম্যাচে মূল একাদশে জায়গা না পেলেও বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রতিটি ম্যাচেই ছিলেন কোচের প্রথম পছন্দ। এবারের বিশ্বকাপেও দলের মূল তারকা হয়ে উঠার সামর্থ্য রয়েছে তাঁর।
গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলা ইংল্যান্ডের লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই ফাইনাল। অন্তত সেমির আগে বিদায় নিলে সেটা হতাশাজনক ফলাফল হিসেবেই বিবেচিত হবে। এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ বি’তে ইংল্যান্ডের সাথে রয়েছে ইরান, যুক্তরাষ্ট্র এবং ওয়েলস। স্বাভাবিকভাবেই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেই পরের রাউন্ডে উঠার কথা থ্রি লায়ন্সের। অন্যথায় দ্বিতীয় রাউন্ডেই মুখোমুখি হতে হবে শিরোপাপ্রত্যাশী নেদারল্যান্ডসের।
তবে, সে বাঁধা পেরোলেও কোয়ার্টারে বড় বাঁধাই অপেক্ষা করবে তাঁদের জন্য, আর্জেন্টিনা কিংবা ফ্রান্সের সাথে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষাই দিতে হবে তাঁদেরকে। তবে ইংল্যান্ডের এই দলটার সামর্থ্য আছে বিশ্বের যেকোনো দলকে হারিয়ে দেবার। কেবল বড় ম্যাচে স্নায়ুচাপ সামলে নিজেদের খেলাটা খেলতে পারলেই শিরোপা খুব বেশি দূরের মনে হবে না ইংল্যান্ডের সমর্থকদের কাছে।