একটা চুমুর গল্প

এক পা খুড়িয়ে খুড়িয়েই বলটা করলেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। তখনও তাঁর ১১ টা বল ছোঁড়া বাকি। পুরো পাকিস্তান তাকিয়ে এই মানুষটার দিকে। তবে আজকে ভারটা সইতে পারলেন না। বলা ভাল পায়ের চোটটা আফ্রিদিকে আঁটকে দিল। ওভার অসমাপ্ত রেখেই ফিরে যেতে হচ্ছে। পা দুটো বারবার আঁটকে যাচ্ছে যেন। মাঠটা ছাড়তে চাইছেন না। বিশ্বকাপের ফাইনালে নিজের কাজটা শেষ করে যেতে চান। তবে নিয়তি বোধহয় সেটা চায়নি।

চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়েই মাঠ ছাড়লেন। মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ৮০ হাজার দর্শক থমকে গেল। যে স্টেডিয়ামের গর্জন ক্রিকেটের প্রান, সেই স্টেডিয়ামেই এক মুহূর্তের নীরবতা। থমকে থাকা মুহূর্তটা কাজে লাগালেন বেন স্টোকস। আরেকটা বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক হবার সুযোগ তাঁর সামনে।

অনেকক্ষণ ধরেই একপ্রান্তে ইংল্যান্ডের মশালটা বয়ে চলেছেন তিনি। মেলবোর্নের উইকেটে সহজে রান আসছিল না। এরপর শাহীন শাহ আফ্রিদি, হারিস রউফ, নাসিম শাহদের একেকটা বল যেন ছোবলের মত আসছিল। অফ স্ট্যামে পিচ করে সাপের মত বাক নিয়ে বের হয়ে যাবে। ব্যাটসম্যান শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবেন। এটাই যেন নিয়ম। এমন একটা পরিস্থিতিতেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। শেষ পর্যন্ত থাকতে চান তিনি।

অনেকক্ষণ ধরে বয়ে চলা মশালটা জ্বালিয়ে দেয়ার সুযোগ এল। শাহীন শাহ আফ্রিদির অসমাপ্ত ওভারের বাকি পাঁচটা বল করতে হবে ইফতেখার আহমেদকে। ব্যাট হাতে কিংবা ফিল্ডিং সব জায়গাতেই আজ দিনটা বাজে যাচ্ছিল তাঁর। এবার বল হাতে এমন গুরুদায়িত্ব। বিশ্বকাপের ফাইনাল, ক্রিজে আছে বেন স্টোকস ও মঈন আলী।

ব্যাটিং ব্যর্থতা, ফিল্ডিং ব্যর্থতা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়ার সুযোগ ছিল তাঁর সামনে। তাঁর পাঁচটা বল থেকে নতুন উপাখ্যান লেখা হতে পারে। বাবর আজমও নিশ্চয়ই সেই আশাতেই বলটা তুলে দিয়েছিলেন। তবে বল হাতেও দিনটা ভুলে যেতে চাইবেন ইফতেখার। পাঁচ বল করে খরচ করলেন ১৫ রান।

ব্যস, ওই পাঁচটা বলই যথেষ্ট ছিল ইংল্যান্ডের জন্য। ওই পাঁচটা বলই মনে করিয়ে দিল শাহীন শাহ আফ্রিদিকে আজ কতটা প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের। ক্রিকেট হয়তো আরেকবার বেন স্টোকসকেই ফাইনালের নায়ক হিসেবে দেখতে চেয়েছে। তাইতো শেষ রানটা তাঁর ব্যাট থেকেই এল। তিনিই হয়তো সবচেয়ে বেশি প্রাপ্য ছিলেন।

অস্ট্রেলিয়া দল ফাইনাল খেলতে পারেনি। তবুও মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়াম দুহাত ভরেই দিয়েছে। বিশ্বকাপের ফাইনালে যে আমেজটা থাকার কথা হয়তো তারও খানিকটা বেশিই ছিল। আশি হাজার দর্শকের চিৎকার, নীরবতা, হাসি, কান্না, সবকিছুই ক্রিকেটের মুগ্ধতা বাড়িয়েছে। বিশ্বকাপ ফাইনালের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। আর লাল জার্সি পরা ইংল্যান্ড দল যখন ট্রফিটা নিয়ে লাফিয়ে উঠল তখনই বুঝি এতসব আয়োজনের ষোলকলা পূর্ণ হল।

অধিনায়ক জশ বাটলারই তো এই ট্রফিটার সবচেয়ে যোগ্য দাবিদার। তাইতো চ্যাম্পিয়ন্স লেখা বোর্ডটার সামনে ট্রফিটা নিয়ে বসতে পারলেন এই অধিনায়ক। তাঁর এক পাশে এবারের আসরের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট স্যাম কুরান। আরেক পাশে আজকের ম্যাচের অন্যতম দুই নায়ক মঈন আলী ও আদিল রশিদ।

দলের সাথে উদযাপন শেষ করেই বাটলার ছুটে গেলেন নিজের পরিবারের কাছে। বাটলারের এই সাফল্যের পেছনে তাঁর স্ত্রী লুইস বাটলারের অবদানও নিশ্চয়ই কম নয়। তাইতো ট্রফিটা হাতে নিয়ে লুইসের ঠোটে চুমু একে দিলেন। যে চুমুতে ভালোবাসা ছিল, কৃতজ্ঞতা ছিল, হয়তো ধন্যবাদ জানানোর একটা প্রয়াসও ছিল। এত ক্রিকেটীয় লড়াই, এত গুলো ম্যাচ, এত আয়োজন সবকিছু বুঝি স্রেফ এই মুহূর্তটার জন্যই।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link