বিশ্বকাপে ক্লাব ফুটবলের দ্বৈরথ

গত ছয় বিশ্বকাপ জয়ী দলগুলোর নাম জিজ্ঞেস করলে হয়তো সবাই উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয় তাঁরা কোন ক্লাব থেকে এসেছেন? এক লহমায় উত্তরটা দেয়া মোটেই সহজ হবে না। 

১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকে এখনও পর্যন্ত ১৩৭ জন ফুটবলার পেয়েছেন বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ। ছয়টি ভিন্ন লিগের ৪৭টি দল থেকে এসেছেন এই ফুটবলাররা। আসুন দেখে নেয়া যাক কোন ক্লাবগুলো বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সফল। 

  • চ্যাম্পিয়ন

বিগত ছয় বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলের বেশিরভাগ ফুটবলারই এসেছেন রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং বায়ার্ন মিউনিখ থেকে। এই সময়টাতে ক্লাব ফুটবলেও সফল এই তিন দল, এর মাঝে অনুষ্ঠিত ২৫ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মাঝে ১৫টিই জিতেছে তাঁরা। এই তিন দল থেকে ২৮ জন ফুটবলার গলায় ঝুলিয়েছেন বিশ্বকাপ জয়ের মেডেল।

২০১০ বিশ্বকাপে প্রথম বারের মত বিশ্ব জয়ের স্বাদ পায় স্পেন। লা রোজাদের সেবারের স্কোয়াডের সাত জনই ছিলেন বার্সেলোনার ফুটবলার। ফাইনালের একমাত্র গোলদাতা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার পাশাপাশি জেরার্ড পিকে, কার্লোস পুয়োল, জাভি, সার্জিও বুসকেটস, পেদ্রো ছিলেন ফাইনালের একাদশে। এছাড়া দলের দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক হিসেবে বেঞ্চে ছিলেন ভিক্টর ভালদেস।

এছাড়া ২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপে বার্সার ফুটবলার হিসেবে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন রিভালদো। বিশ্বকাপ জয়ী বার্সেলোনার ফুটবলারের তালিকায় সর্বশেষ দুই নাম স্যামুয়েল উমতিতি এবং উসমান ডেম্বেলে। ২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন এই দুই তারকা।

যে তিনবার বিশ্বকাপ জয়ী দলের অংশ ছিলেন বার্সার ফুটবলাররা, সেই তিনবারেই দলে ছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের ফুটবলারও। ২০১০ সালে স্পেনের অধিনায়ক ছিলেন ইকার ক্যাসিয়াস, তাঁর পাশাপাশি একাদশের নিয়মিত মুখ ছিলেন সার্জিও রামোস এবং জাবি আলানসো। এছাড়া বেঞ্চে ছিলেন রাউল আলবিওল এবং আলভারো আরবোয়েলা।

এছাড়া ২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন কার্লোস আলবার্তো। রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের পথে রক্ষণে মূল ভরসা ছিলেন রাফায়েল ভারানে। এদের পাশাপাশি ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্সের ক্রিশিয়ান কারেম্বু এবং ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ী স্যামি খেদিরা ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ফুটবলার। 

বায়ার্নের হয়ে নয়জন বিশ্বকাপ জয়ীর মাঝে সাতজনই ছিলেন ২০১৪ বিশ্বকাপ জয়ী জার্মান দলের সদস্য। ফাইনালে গোল করা মারিও গোটজের পাশাপাশি ম্যানুয়েল নয়্যার, জেরোম বোয়াটেং, ফিলিপ লাম, বাস্তিয়ান শোয়েনস্টাইগার, টনি ক্রুস, থমাস মুলার ছিলেন বায়ার্নের ফুটবলার। এছাড়াও ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জয়ী বিক্সেন্তে লিজারাজু এবং ২০১৮ বিশ্বজয়ী  ক্লোরেন্টিন তোলিসো ক্লাব পর্যায়ে খেলেছেন বায়ার্নের হয়ে। 

এছাড়াও আর সাতটি ক্লাব থেকে উঠে এসেছেন কমপক্ষে পাঁচটি বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার। ইতালিতে জুভেন্টাস থেকে আটজন ফুটবলারের পাশাপাশি এসি মিলান থেকে সাতজন এবং রোমা থেকে ছয়জন ফুটবলার জিতেছেন বিশ্বসেরার খেতাব। ইপিএলের দলগুলোর মাঝে আর্সেনাল থেকে সর্বোচ্চ ছয়জন পেয়েছেন বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ। অন্যদিকে ফ্রান্সের মার্শেই, পিএসজি, মোনাকো থেকে পাঁচজন করে ফুটবলার জিততে পেরেছেন বিশ্বকাপ।

  • রানারআপ

বিশ্বকাপ রানার আপের দিকে তাকালে কেবল ইউরোপিয়ান পাঁচ লিগ নয় বরং ফুটবলাররা এসেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আর্জেন্টিয়ান প্রিমেরা ডিভিশন, অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলিগা, বেলজিয়ান ফার্স্ট ডিভিশন এমনকি মেক্সিকান লিগের ফুটবলারও ছিলেন বিশ্বকাপে রানার্স আপ দলের অংশ। 

বায়ার্ন মিউনিখ, বায়ার লেভারকুসেন, ইন্টার মিলান থেকে সাতজন করে ফুটবলার এখনও পর্যন্ত রানার্স আপ হয়েছেন বিশ্বকাপে। মজার ব্যাপার হল, ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে এখনও পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপ ফাইনালেই ছিলেন বায়ার্ন এবং ইন্টার মিলানের অন্তত একজন করে ফুটবলার।

এছাড়াও অলিম্পিক লিওন, বার্সেলোনার পাঁচজন এবং রিয়াল মাদ্রিদের ছয়জন ফুটবলার জিতেছেন রানার্স আপের খেতাব। ভুলে গেলে চলবে না উইগান অ্যাথলেটিককেও, ২০০৬ বিশ্বকাপের রানার্সআপ ফ্রান্স দলের সদস্য ছিলেন উইগানের প্যাসকাল চিমবোন্ডা।

  • ঘরের ছেলে

এবারের বিশ্বকাপে কাতার অভূতপূর্ব কিছু করে না ফেললে কেবল দেশের ঘরোয়া লিগের ফুটবলারদের নিয়ে বিশ্বকাপ জেতার ঘটনা ঘটবে না। একমাত্র দেশ হিসেবে ইতালি দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছে কেবল সিরি আ’র ফুটবলারদের নিয়ে যথাক্রমে ১৯৮২ এবং ২০০৬ বিশ্বকাপে। সেবারের বিশ্বকাপে মার্সেলো লিপ্পির স্কোয়াডের সবাই খেলতেন ইতালিতেই।

এরপর থেকেই মূলত ঘরোয়া লিগের ফুটবলারদের আধিপত্য দেখা যেতে শুরু করে বিশ্বকাপ জয়ী দলগুলোর স্কোয়াডে। ২০১০ সালে বিশ্বকাপজয়ী স্পেনের স্কোয়াডে বাইরের লিগ খেলা ফুটবলার ছিলেন মাত্র তিনজন। ফার্নান্দো তোরেস, পেপে রেইনা, সেস্ক ফ্যাব্রেগাস তিনজনই খেলতেন ইপিএলে। চার বছর বাদে জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী স্কোয়াডের সাতজন খেলতেন বাইরের দেশের লিগে।

এর মাঝে আর্সেনালেই খেলতেন তিনজন, যথাক্রমে মেসুত ওজিল, লুকাস পোডোলস্কি এবং পের মের্টেসেকার। তবে সর্বশেষ বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের স্কোয়াডের বড় অংশই ছিলেন বাইরের লিগে খেলা ফুটবলার, মোট ১৪ জন ফুটবলার ক্লাব ফুটবল খেলতেন ফ্রান্সের বাইরে। 

২০২২ বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট ইংল্যান্ড এবার ভরসা রাখছে ইপিএলে খেলা ফুটবলারদের উপর। একমাত্র ব্যতিক্রম জুড বেলিংহাম, তরুণ এই মিডফিল্ডার খেলেন জার্মান ক্লাব  বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে। ইংল্যান্ডের ইপিএল প্রীতি অবশ্য নতুন নয়, একমাত্র ২০০৬ বিশ্বকাপ বাদে প্রতিবারই তাঁরা ভরসা রেখেছে ঘরোয়া লিগে খেলা ফুটবলারদের উপরেই। 

  • ফাইনালের গোলদাতা

১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ছয়টি বিশ্বকাপে মাত্র একবারই বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছে ইতালি। অথচ এই ছয় ফাইনালের ১৫ গোলের আটটিই করেছেন ইতালিতে খেলা ফুটবলার। এই ফুটবলাররা খেলেছেন ইন্টার মিলান এবং জুভেন্টাসে। 

২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালির হয়ে সমতা ফেরানো গোলটাও করেছিলেন ইন্টার মিলানের এক ফুটবলার, মাতেও মাতেরাজ্জি। যদিও গোল ভুলে তাঁকে সবাই মনে রেখেছে জিনেদিন জিদানের সেই বিখ্যাত ঢুসের জন্য। 

ইন্টারের আরেক তারকা ব্রাজিলিয়ান রোনালদো ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে করেছিলেন জোড়া গোল। এছাড়াও নেরাজ্জুরিদের হয়ে খেলা ক্রোয়েশিয়ান ইভান পেরিসিচ গোল করেন ২০১৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে। অন্যদিকে জুভেন্টাসের হয়ে খেলা আরেক ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার মারিও মানজুকিচও স্কোরবোর্ডে নাম তোলেন ২০১৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে। 

*এই লেখার সমস্ত তথ্য উপাত্ত ১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে ২০২২ বিশ্বকাপ শুরুর দিন পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link