আমাদের রতনের ওভাল জয়!

বলুন তো, ইংলিশ ক্রিকেটের প্রতীক দ্য ওভালের নাম এখন কী? একটু যারা খোজখবর রাখেন, তারা হয়তো গোফটা একটু মুচড়ে, মুচকি হেসে বলবেন-কিআ ওভাল।

আজ্ঞে না, আপনি একটু ভুল করছেন। আজ ১৫ ডিসেম্বর ভুবনবিখ্যাত দ্য ওভালের নাম রাখা হয়েছে-কিআ শহীদুল আলম রতন ওভাল!

বিশ্বাস করুন, কিআ ওভালের নাম এখন রতন ওভাল।

আমাদের রতন। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের এক সময়ের পরিচিত মুখ রতন, বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলগুলোর কোচ রতন, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক কোচ রতন; শহীদুল আলম রতন। আমাদের রতন ভাই। আমাদের রতন ভাই লন্ডনের ওভাল জয় করে ফেলেছেন।

আচ্ছা, আগে এই ওভাল জয়ের গল্পটা বলে নেওয়া যাক।

শহীদুল ইসলাম রতন এখন লন্ডনের ‘ক্যাপিটাল কিড ক্রিকেট’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধাণ নির্বাহী। এই সংস্থাটি ইংল্যান্ডের আরও হাজার বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারী বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনুদান পেয়ে থাকে। এই করোনা লক ডাউনের আগে আগে তারা অনুদান পেয়েছিলো ‘ন্যাশনাল লটারি ফাউন্ডেশন’-এর। আর এই অনুদান কাজে লাগিয়ে লক ডাউনের এই সময়টা রতন ও তার সংস্থা লন্ডন এবং ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে ঘরে আটকে থাকা হাজারো তৃনমূল ক্রিকেটারের পাশে দাড়িয়েছিলো। আর এরই স্বীকৃতি হিসেবে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিসি) ও সারেক ক্রিকেট ক্লাব ২৪ ঘন্টার জন্য কিআ ওভালের নাম বদলে রতনের নাম যুক্ত করে ফেলে।

কথা বলতে গিয়ে রতনের গলা বারবার ধরে আসছিলো। তিনি কেবল বলতে পারলেন, ‘এটা অনেক বড় সম্মান। আমি বুঝিয়ে বলতে পারছি না। এটা আসলে অনেক বড় অনার। তবে আমি বলবো, এটা আমার একার সম্মান নয়। আমি বলবো, এটা আমার একার নাম নয়। এটা বাংলাদেশের নাম। আমি আজ একজন বাংলাদেশী হিসেবে গর্বিত।’

রতন আদ্যোপান্ত বাংলাদেশী।

ছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। খেলেছেন ওয়ারী থেকে মোহামেডান; নিয়মিত ঢাকার ক্রিকেট। এমসিসির হয়ে আন অফিশিয়াল বাংলাদেশ জাতীয় দলেও খেলেছেন। তবে অল্প বয়সেই নব্বই দশকের মাঝামাঝি ক্রিকেট ছেড়ে দ্রুতই কোচিংয়ে চলে আসেন। ইংল্যান্ড থেকেই কোচেস কোর্স তিন লেভেল সম্পন্ন করেন। এর মধ্যেই দেশে ক্লাব ক্রিকেটে কোচিং শুরু করে দেন।

২০০১ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে চাকরি নেন তরুন কোচ হিসেবে। এখানে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের সাথে কাজ করেন তিনি। রিচার্ড ম্যাকিন্সের বিখ্যাত অনুর্ধ্ব-১৯ দলের সেটআপ ও হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের কোচও ছিলেন রতন।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চাকরি ছেড়ে চলে যান মালয়েশিয়াতে। সেখানে মালয়েশিয়া যুব দলের কোচ হিসেবে বিশ্বকাপেও কাজ করেছেন। আর মালয়েশিয়া থেকেই তাকে লন্ডনে নিয়ে যায় ক্যাপিটাল কিড ক্রিকেট। শুরুতে তাদের গেম ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা ও কোচ হিসেবে কাজ করলেও গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন প্রধাণ নির্বাহী হিসেবে।

এই সংস্থার দায়িত্ব নিয়ে রতন ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ইংল্যান্ডের তৃনমূল পর্যায়ে। নিজেদের কাম সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘আমরা সারে, মিডলসেক্সসহ বিভিন্ন কাউন্টি ক্লাবের সাথে কাজ করি। মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ক্রিকেটের সাথে রাখার জন্য অলাভজনক সংস্থা হিসেবে কাজ করি আমরা।’

এই কাজটিই তারা জোরদার করলেন লকডাউনের সময়।

এই সময়টা সুবিধাবঞ্চিত, উদ্বাস্তু শিশুদের জন্য কাজ করেছেন রতনরা। তাদের জন্য কোর্স করার পাশাপাশি তাদের নানারকম ক্রিকেট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, লেবাননে সুবিধাবঞ্চিত ক্রিকেটাররা এই সুবিধা নিয়েছে। ১৩০টি পরিবারকে নিয়ে জুমে এই কোরেন্সর সমাপনী অনুষ্ঠান হয়েছে।

লকডাউনের সময়ের নিজেদের কাজ নিয়ে রতন বলছিলেন, ‘এই সময়টা অল্পবয়সী ক্রিকেটারদের জন্য কঠিন ছিলো। তারা হতাশ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো। আমরা তাই ওদের জন্য নানা ধরণের অনলাইন ক্লাস, অনলাইন কোর্স নিয়ে এলাম। আমরা আস্তে আস্তে এটা লন্ডনের বাইরে, এমনকি ইংল্যান্ডের বাইরেও ছড়িয়ে দিলাম। আমাদের এই ফান্ডটা দিচ্ছিলো ন্যাশনাল লটারি। আমাদের কোচিং দলকে আমরা বলেছি, এমনভাবে কোচিং সেটআপ করতে, যেটা যেনো যে কোনো ঘরেই করা সম্ভব হয়।’

আর ইংল্যান্ড সরকারের এই সংস্থাটি তাদের তহবিল পাওয়া কয়েক হাজার সংস্থার ভেতর থেকে ৬ জন স্বেচ্ছাসেবীকে বেছে নিলো। ৬টি ক্রীড়া স্থাপনার সাথে তারা চুক্তি করলো যে, এই ৬ জনকে সম্মান জানাতে স্থাপনাগুলোর নাম ২৪ ঘন্টার জন্য পাল্টে ফেলা হবে। তারই ফল হিসেবে এই কিআ ওভালের নামকরণ।

রতনের এই কর্মকান্ডের বিপুল প্রশংসা করেছেন ইংল্যান্ডের ক্রীড়া বিভাগ। আর রতন যখন এইসব কথা বলছিলেন, চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিলো কিআ ওভালের নতুন নাম ফলকটা। যেনো সেখানে রতনের নাম লেখা নেই। লেখা আছে-দ্য বাংলাদেশ ওভাল।

রতন এখন একজন বাংলাদেশ!

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link