১৯৬৯ সালের শেষ দিকে ভারতে জন্ম হল নয়ন মোঙ্গিয়ার আর ১৯৭১-এ অস্ট্রেলিয়াতে গিলক্রিস্টের। এবারে ২০০১ সালে মোঙ্গিয়া যখন জীবনের শেষ টেস্ট খেলছেন তখন গিলক্রিস্টের টেস্ট ক্যারিয়ারের আয়ু মাত্র দুই বছর। একবার ভেবে দেখুন! যে ছেলেটা বিশ্ব ক্রিকেটে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিল তার কিনা টেস্ট ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটল ২৮ বছর বয়সে!
অথচ অনেক কম যোগ্যতার মোঙ্গিয়ার ততদিনে প্রায় ছয় বছর ভারতের হয়ে খেলা হয়ে গেছে। এর কারণ কি? অস্ট্রেলীয় নির্বাচকরা কি গিলির প্রতিভা নিয়ে সন্দিহান ছিল? নাকি লবিবাজির ফলে দলে জায়গা হয়নি গিলির? আসল কারণ এর কোনোটাই নয়।
আসলে গিলির আগে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একজন টেস্ট খেলতেন যার ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ২৭, সেঞ্চুরি ছিল মাত্র চারটি, তাও ১১৯টি টেস্ট খেলে। কিন্তু, তিনি ছিলেন সেসময় দুনিয়ার অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক। নাম ইয়ান হিলি।
চরম পেশাদার ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, যাদের কাছে ঠুনকো আবেগের কোনো দাম নেই, যারা বিশ্বজয়ী অধিনায়ককে দুই বছরের মধ্যে দল থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারে শুধুমাত্র ভবিষ্যতের কথা ভেবে, তারা গিলির মতো প্রতিভাকে টেস্ট অভিষেকের জন্য ২৮ বছর পর্যন্ত বসিয়ে রাখলো কারণ তারা মনে করেছিল শুধুমাত্র উইকেটরক্ষক হিসেবে হিলি এগিয়ে গিলির থেকে (সেই সময়ের নিরিখে)। তাই গিলির অর্ধেকেরও কম ব্যাটিং যোগ্যতা নিয়েও হিলি টেস্ট খেলে গেছেন শুধুমাত্র তুলনায় ভাল (আবার বলছি অন্তত সেই সময়ের নিরিখে) উইকেটরক্ষক বলে।
২০১৬ সালের ইডেন টেস্ট। ভারত বনাম নিউজিল্যান্ড। কলকাতায় প্রবল নিম্নচাপের পরিবেশের মধ্যে সবুজ উইকেটে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচ যার প্রায় প্রতিটি দিন খেলা শেষ করতে হয়েছিল কৃত্রিম আলোয়। এরকম গতিসম্পন্ন উইকেটে এবং স্যুইং সহায়ক পরিবেশে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে মাত্র একটা ক্যাচ ধরা সত্বেও বিশেষজ্ঞরা ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা তুলে দিলেন ঋদ্ধিমান সাহার হাতে।
কিন্তু কেন? দুই ইনিংসে মোহাম্মদ শামি এবং ভুবনেশ্বর কুমারের অনবদ্য পারফরম্যান্স এর মধ্যেও বিশেষজ্ঞদের কাছে গুরত্বপূর্ন লেগেছিল কঠিনতম পরিস্থিতিতে ‘ব্যাট করতে না পারা’ সাহার দুই ইনিংসে করা দুটি অনবদ্য হাফ সেঞ্চুরি। হ্যাঁ, আজকের ‘ব্যাট ধরতে না পারা’ ঋদ্ধিমান সাহা সেদিন টেস্ট ম্যাচে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন শুধু ব্যাটিংয়ের জোরে।
আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। আমাদের শুধু মনে থাকে যে শেষ অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড সফরে ঋষভ পন্থের শতরান আছে। আর হ্যাঁ এই ব্যাট করতে না পারা ঋদ্ধির টেস্টে ব্যাটিং গড় কিন্তু ওই ইয়ান হিলির থেকে ভালো। যদি খুব ভুল না করি ভারতের টেস্ট ইতিহাসের দ্বিতীয় উইকেটরক্ষক হিসেবে তাঁর উপমহাদেশের বাইরে টেস্ট শতরান আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল – ‘ছেলেটা ব্যাট করতে পারে না’!
৫০ ওভারের ক্রিকেটে খুব বেশি হলে একটা ইনিংসে ১০ শতাংশ বল সরাসরি কিপারের হাতে পৌঁছয়। আর বাকি বলগুলো ব্যাটসম্যান খেলে দেয়। তাই সেখানে মেকশিফট কিপার দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যায়। ওই ফরম্যাটে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের উইকেটের পিছনের দক্ষতা আর সামনের দক্ষতা সমান ভাবে গুরত্ব পায়। কিন্তু পাঁচদিনের ফরম্যাটটাই আলাদা। সেখানে বল প্রথম দিন স্যুইং করবে তো শেষ দিন দুই ইঞ্চি করে স্পিন করবে, লাফাবে। তাই এখানে উইকেট কিপিংটা সম্পূর্ণ ভাবে বিশেষজ্ঞের কাজ।
ঠিক এই কারণেই ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর থেকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) গিলিকে একদিনের ম্যাচে সুযোগ দিলেও টেস্টে হিলিকে খেলিয়ে গিয়ে ছিল ১৯৯৯ পর্যন্ত। এখানে প্রকৃত অভিজ্ঞতা আর দক্ষতার পরীক্ষা হয়, যে কারণে ফরম্যাটটার নাম টেস্ট। আর উইকেট কিপিং দক্ষতায় যে ঋদ্ধিমান সাহা, ঋষভ পান্তের থেকে যে কয়েক যোজন এগিয়ে সেটা নিশ্চই আলাদা করে বুঝিয়ে দিতে হবে না।
আর যদি দিতেই হয় তাহলে একটাই কথা বলা যাক। ৩৭ টি টেস্ট যেখানে উইকেটের পেছনে সাহা ছিল সেখানে ভারত বাই রান দিয়েছে মোট ১৭৯ আর যে ১৩ টা টেস্টে পান্ত কিপিং করেছে সেখানে বিপক্ষের ইনিংসে যুক্ত হওয়া মোট বাই রানের সংখ্যা ১৬৭।
আনুপাতিক হার অতি সহজেই অনুমেয়। এমন অবস্থাতে কিছু লোক উঠেপড়ে লেগেছে এই বলতে যে পান্তকেই যোগ্যতর হিসেবে টেস্টে খেলানো হোক। ভারতীয় দলের ম্যানেজমেন্টও এই ভাবনার পালে হওয়া দিচ্ছে ইচ্ছেমতো টেস্টে সাহাকে বসিয়ে। যদিও, বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির শুরুটায় জয় হল ঋদ্ধিরই। যোগ্যতার বলেই জায়গা করে নিলেন টেস্ট একাদশে।
একবারও বলছি না যে ঋষভ পান্ত অযোগ্য। পান্ত যথেষ্ট প্রতিভাধর। ওর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। কিন্ত ওকে অপেক্ষা করতে হবে, যেভাবে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও গিলি, ম্যাকগিল, রঙ্গনাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল হিলি, ওয়ার্ন, মুরালির অবসরের জন্য। এমনকি ঋদ্ধিকেও অপেক্ষা করতে হয়েছিল ধোনির অবসরের জন্য। ক্রিকেট বারবার শিখিয়েছে ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।’ ঋষভকেও সেই বাস্তবতা মানতে হবে।