এক ভেলকিবাজ বুড়ো

২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ফ্রান্স, সেই বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন স্ট্রাইকার অলিভার জিরুড। কিন্তু ফ্রান্সের তারকাবহুল স্কোয়াডে তিনি ছিলেন বেমানান; তাঁর পারফরম্যান্সও ছিল হতাশাজনক। ফ্রান্সের তৎকালীন দলের মূল স্ট্রাইকার হয়েই ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন জিরুড অথচ পুরো টুর্নামেন্টে গোল তো দূরে থাক প্রতিপক্ষের পোস্টে কোন শটই নিতে পারেননি তিনি।

এমন বিব্রতকর পারফরম্যান্সের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই জাতীয় দল থেকে প্রায় ছিটকে গিয়েছিলেন অলিভার জিরুদ। তবে কাতার বিশ্বকাপের স্কোয়াডে অভিজ্ঞ শিষ্যের উপর আবারো ভরসা রাখেন কোচ দিদিয়ের দেশম। তবে সেজন্য সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল ফরাসি এই কোচকে।

কিন্তু মাঠে নামতেই সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন জিরুড; প্রমাণ করেছেন এখনো ফুরিয়ে যাননি তিনি। কাতারে বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখাতে শুরু করেছেন এই ফরোয়ার্ড।

শুরুটা হয়েছিল বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ দিয়েই; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেদিন জোড়া গোল করে আলোচনায় উঠে আসেন অলিভার জিরুড। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি এই ফুটবলারকে। গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচে গোল না পেলেও নক আউট পর্বে আবারো জ্বলে উঠেন তিনি। ঠিক প্রয়োজনের সময় গোল করে দলকে এগিয়ে নেন ৩৬ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার।

রাউন্ড অব সিক্সটিনে পোল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর মাধ্যমেই গোলের খাতা খুলেছিল বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। আর কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জিরুদের মাথা থেকেই এসেছে জয়সূচক গোল। আল বায়াত স্টেডিয়ামে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে মিডফিল্ডার অরেলিয়েন চুয়ামেনির দূরপাল্লার শটে ১৭ মিনিটের সময় এগিয়ে যায় ফ্রান্স। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে সেই চুয়ামেনি বক্সের ভেতর বুকায়ো সাকাকে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ইংল্যান্ড। স্পটকিক থেকে দলকে সমতা ফেরান ইংলিশ তারকা হ্যারি কেইন।

আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ম্যাচের ভাগ্য যখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে, তখনই আঁতোয়ান গ্রিজম্যানের ক্রসে দুর্দান্ত এক হেডে ইংল্যান্ডের জালে বল পাঠিয়ে নায়ক বনে যান অলিভার জিরুদ। ম্যাচের বাকি সময় আর গোল না হওয়ায় জিরুদের গোলেই সেমিফাইনালে জায়গা পায় ফরাসিরা।

সেমিফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে বল পোস্টে না লাগলে এদিন দারুণ এক গোল লেখা হতো অলিভার জিরুদের নামের পাশে। এছাড়া পোল্যান্ডের বিপক্ষে এই মিলান তারকার দুর্দান্ত এক গোল ফাউলের অজুহাতে বাদ দিয়েছিল রেফারি, দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি না ঘটলে বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা গোলের মালিক হতে পারেন তিনি।

২০১৮ সালের বিশ্বকাপে কোন গোল না করা অলিভার জিরুড চলতি আসরে সবমিলিয়ে পাঁচ ম্যাচে করেছেন চার গোল। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় যৌথভাবে আছেন দ্বিতীয় স্থানে, ভাগ্য মুখ তুলে তাকালে সবার উপরে থাকা সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপ্পেকে হটিয়ে গোল্ডেন বুট পেলেও পেতে পারেন এসি মিলান তারকা।

বলাই যায়, মধ্যপ্রাচ্যে আয়োজিত ফুটবলের বিশ্ব আসরে দেখা মিলেছে ভিন্ন এক জিরুডের। বল পায়ে নিখুঁত আর প্রয়োজনের সময় গোল করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিলিয়ান এমবাপ্পে আর আঁতোয়ান গ্রিজমানের জুটিকে পরিপূর্ণতা দিতে যা প্রয়োজন ছিল ঠিক সেটাই করছেন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এই স্ট্রাইকার।

অথচ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকলেও অলিভার জিরুড ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবেন কি না সেটি নিয়ে সংশয় ছিল। কেননা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে জাতীয় দলে ফিরেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়ক করিম বেনজেমা। দারুণ ছন্দে থাকা বেনজেমা চলতি বছরেই জিতেছেন লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের পুরস্কার হিসেবে হাতে উঠেছে ব্যালন ডি’অর।

তাই তো বিশ্বকাপ ধরে রাখার মিশনে দিদিয়ের দেশমের পরিকল্পনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকবেন বেনজেমা সেটি ছিল নিশ্চিত। তবে তাঁর ইনজুরি বদলে দিয়েছে দৃশ্যপট; কোন ম্যাচ না খেলেই ফিরে যেতে হয়েছে ফ্রান্সে। বদলি হিসেবে কোন নতুন খেলোয়াড়কে আনার সুযোগ না থাকায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে অলিভার জিরুডের উপর নির্ভর করতে হয় দেশ্যমকে।

কুড়িয়ে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে এবার অবশ্য ভুল করেননি তিনি। ফরাসি ভক্তদের ব্যালন ডি’অরজয়ী করিম বেনজেমার অভাব টেরই পেতে দিচ্ছেন না তিনি। ক্যারিয়ারের মাঝপথে যা করতে পারেননি অলিভার জিরুদ, সেটিই করে দেখাচ্ছেন শেষ বয়সে এসে।

৩৬ বছর বয়সে যেখানে অনেক ফুটবলার খোঁজেন অবসরের পথ, অলিভার জিরুদ সেখানে মাতিয়ে রাখছেন পুরো একটা বিশ্বকাপ। তাঁর এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে মানতেই হবে পুরনো চাল ভাতে বাড়ে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link