ট্রফিটার ওপরে আলতো করে একটু হাত রাখলেন। হাতটাকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। একটু করে চুমু খেলেন। চোখ দুটো জ্বলে উঠল। শিশুদের মত হেসে উঠলেন। আমি পাগলের মত কেঁদে ফেললাম। আমি হো হো করে হাসলাম।
বড় কাঁদলাম। আশেপাশে কারো কথা আজ আর ভাবলাম না। মনের আগল খুলে গিয়ে কাঁদলাম। এই কান্নাটা সেই ১৯৯০ সাল থেকে জমিয়ে রেখেছিলাম।
বাবা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ কিনে এনেছিলেন খুলনা থেকে। সেটাই ছিলো আমার স্কুল ব্যাগ। ব্যাগের ওপর একটা ঝাকড়া চুলো মানুষের ছবি ছিলো। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে নামটা পড়েছিলাম—ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেই আমার স্বপ্নের বীজ বোনা।
তারপর কতকাল চলে গেছে। বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া, ওর্তেগা, সোরিন, রিকেলমে, তেভেজ, মাশেরানো, ভেরন – কত শত নাম। সব মাথায়ও আসছে না আজ। কত জনের ওপর ভর করলাম। কেউ আমাকে সেই স্বপ্নটা পূরণ করে দেয়নি। আমি কারো হয়ে আনন্দে কেঁদে উঠতে পারিনি।
২০০৬ সালে আমি এই ক্ষুদে জাদুকরের ওপর ভর করেছিলাম। তারপর তো একে একে অনেক ইতিহাস হল। ফাইনালে গিয়েও বারবার না পাওয়ার বেদনায় পুড়লাম। এই জাদুকরকে দেখেই জীবনটাতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে বলে মনে হয়েছিল। সেও একটা দিন এসেছিল জীবনে।
আমরা বিভিন্ন পত্রিকার কয়েক জন রিপোর্টার লবিতে ভিড় জমিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম হোটেল শেরাটনের লবিতে। আমাদের সাথে কয়েক জন ফটো সাংবাদিক আছেন। এক দল নিরাপত্তা কর্মী এসে হোটেলে ঢোকার মুখেই একটা জায়গা দড়ি দিয়ে ঘিরে দিলেন। বললেন, আমাদের এই জায়গার মধ্যে থাকতে হবে। সেই সাথে কঠোর করে বলে গেলেন, কোনো খেলোয়াড়কে ছোয়া যাবে না, ডাক দেওয়া যাবে না।
এই জায়গাটুকুর মধ্যে গায়ে গা সাটিয়ে দাড়িয়ে আছি আমি, রাজীব হাসান, মোস্তাফা মামুন। মোস্তাফা মামুন তখন স্পোর্টস রিপোর্টিং করেন। এমনকি ব্রাজিল সমর্থক আবিদুল ইসলামও তখন থর থর উত্তেজনায় কাপছেন যে, চোখের সামনে থেকে একটু পরে আর্জেন্টিনা দলের মহা তারকারা হেঁটে যাবেন।
সাইরেনের শব্দ ভেসে এলো। বুঝতে পারলাম, সময় চলে এসেছে। কয়েক মিনিট পরই ঠিক মূল দরজার কাছে এসে থামলো একটা বিশাল বাস। দরজা খুলে যেতেই একজন সাপোর্ট স্ট্যাফ নেমে বের হলেন। এরপর একটু কম চেনা কয়েক জন খেলোয়াড়। তারপর অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া! এক সাথে নামলেন হ্যাভিয়ের মাশেরানো আর গুতিয়েরেজ। কিন্তু সেই মানুষটা কই?
আমরা তখন শ্বাস নিতে ভুলে গেছি। পরস্পরকে শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে আছি। এই তো সময় এল। আমাদের শরীর কাপিয়ে দিয়ে দু জন একসাথে বেরিয়ে এলেন – প্রথমে সার্জিও আগুয়েরো এবং তারপর সেই লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।
মুখে কয়েক দিনের না কাটা খোচা খোচা দাড়ি। পরনে একটা শর্টস আর টিম শার্ট। মুখটা গম্ভীর। মনে হচ্ছিলো এই বাড়ির পাশের ছেলেটা বুঝি। বেশ গতিতে হেটে এগেলেন। আমাদের ইঞ্চি কয়েক দূর থেকে পার হয়ে যাচ্ছিলেন। বাতাসে যেন মেসির গন্ধ পাচ্ছিলাম।
নিষেধাজ্ঞা ভুলে প্রবল প্রানের দাপটে ডাক দিলাম, ‘লিও।’
তিনি ফিরে তাকালেন। হাতটা একটু উচু করলেন এবং ভুবন ভোলানো একটা হাসি দিলেন। আমার জীবনটা ধন্য হয়ে গেলো। হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। মনে হলো এই দিনটার জন্য বেঁচে ছিলাম।
আজ মনে হলো, না। ঈশ্বর আমার জন্য আরেকটু জমা রেখেছিলেন। সেই ক্ষুদে জাদুকরকে এই মঞ্চে সর্বজয়ী হিসেবে দেখবো, কেঁদে দু কূল ভাসাবো; এই জন্যই এই পৃথিবীতে ছিলাম। আমার বেঁচে থাকাটা, ধুকু ধুকু করে টিকে থাকাটা সফল হল; সার্থক হল এই জীবন।
এবার আমি কাঁদি। এবার আমার কেবল কান্নার পালা। দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর; আনন্দে কাঁদিবার দে মোরে অবসর।