আত্মবিশ্বাস, তারুণ্য ও কৌশল: আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্যে

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে লিওনেল মেসি; তাঁকে ঘিরে নাচছে উল্লসিত আর্জেন্টিনা ফুটবল দল। আকাশি-সাদা জার্সিধারীরা একে অপরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন; আর লাউতারো মার্টিনেজ তো মাইক হাতে পুরোদস্তুর গায়ক বনে গিয়েছেন। আর উপর থেকে ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছিলো শ্যাম্পেন – সবমিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ।

অথচ এর মাসখানেক আগে পরিস্থিতি ছিল ঠিক উল্টো। সৌদি আরবের বিপক্ষে হেরে মাথা নিচু করেই মাঠ ছেড়েছিল আর্জেন্টিনা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর র‍্যাংকিংয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে থাকা একটি দলের কাছে হার নিশ্চিতভাবেই লাতিন আমেরিকার প্রতিনিধিদের মানসিক ভাবে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছিল। এক ম্যাচ শেষেই বাদ পড়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল তারা৷

অথচ এই দলটিই কি না একমাসের ব্যবধানে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কি এমন পরিবর্তন এনেছেন কোচ লিওনেল স্কালোনি যা দলের সবাইকে এতটা উজ্জীবিত করেছে, কি এমন কৌশলেই বা বাজিমাত করেছে কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়নরা?

এসব প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হয় ডি পল, মার্টিনেজদের আত্মবিশ্বাসের কথা। টুর্নামেন্ট শুরুর আগ থেকেই এবার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল তাঁরা। একদিন রদ্রিগো ডি পল আর মেসি একই রুমে বিশ্রাম করছিলেন, এমন সময় রদ্রিগো ডি পল একটি কাগজে লিখেন, ‘আজ, ২০ নভেম্বর, কথা দিলাম যে, আমরা এবার চ্যাম্পিয়ন হবো।’

সেই নোটটি এখনো লকার রুমের ফোল্ডারে আছে বলে জানিয়েছেন এই মিডফিল্ডার। ছোট্ট এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় নিজেদের উপর কতটা ভরসা করেছিল আলবিসেলেস্তারা।

এছাড়া লিওনেল মেসির নেতৃত্ব, সতীর্থদের মাঝে শক্ত বন্ধন ও বোঝাপড়া এবং সর্বোপরি বিশ্বাসের জোরেই কাতার বিশ্বকাপ নিজেদের করে নিয়েছে আর্জেন্টিনা। স্বয়ং সৌদি আরব কোচ হার্ভে রেনার্ড আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর বলেছিলেন মেসিরা এখান থেকেই বিশ্বকাপ জিততে পারে; সেই কথাই শেষপর্যন্ত সত্য হয়েছে।

সৌদি আরবের বিপক্ষে সেই পরাজয় অবশ্য একভাবে সাহায্যই করেছে লিওনেল মেসিদের। পরিকল্পনার ভুলগুলো, খেলোয়াড়দের ঘাটতি সহজেই বোঝা গিয়েছে। উদ্বোধনী ম্যাচে খেলা পাঁচজনকে পরের ম্যাচে আর শুরুর একাদশে রাখেননি কোচ স্কালোনি; এর পরের ম্যাচে নতুন আরো দুইজনকে প্রথম থেকেই সুযোগ দেন তিনি। আর এমন পরিবর্তনই আর্জেন্টিনাকে নক আউট ম্যাচে সবচেয়ে সেরা কম্বিনেশন খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে।

টুর্নামেন্ট জুড়ে লিওনেল স্কালোনির পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশে ছিলেন ম্যাক অ্যালিস্টার, জুলিয়ান আলভারেজ এবং এঞ্জো ফার্নান্দেজ। এরা সবাই-ই চ্যাম্পিয়ন দলের সেরা পারফর্মার। এঞ্জো ফার্নান্দেজ তো আসরের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নিয়েছেন। এই তরুণদের উপর ভরসা করাটাও আর্জেন্টিনার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।

শুধু খেলোয়াড় নয়, প্রতিপক্ষ বিবেচনায় কৌশলেও বারবার পরিবর্তন এনেছিলেন আর্জেন্টাইন কোচ। এই মাস্টারমাইন্ড মনে করেন, ‘একটি নির্দিষ্ট কৌশল সবসময় অনুসরণ করাটা আপনার জন্য খারাপ কিন্তু বয়ে আনতে পারে।’

এজন্যই ৪-৪-২, ৪-৩-৩, ৫-৩-২ এর মত বিভিন্ন ছকে শীর্ষদের খেলিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ম্যাচ পরিস্থিতি ভেদেও পরিকল্পনায় রদবদল এনেছে আর্জেন্টিনা। কখনো বল দখলো এগিয়ে থাকার জন্য প্যারাদেসকে ব্যবহার করা হয়েছে, কখনো আবার উইং দিয়ে আক্রমণ করার জন্য মাঠে নামানো হয়েছে ডি মারিয়াকে।

লিওনেল স্কালোনি বলেছিলেন, ‘দ্য সান উইল রাইজ টুমরো।’ মেসি বলেছিলেন বিশ্বাস রাখতে। সেই আকাঙ্খিত সূর্য ঠিকই উঠেছে আর্জেন্টিনার আকাশে, মেসিও প্রতিদান দিয়েছেন ভক্তদের বিশ্বাসের। জার্সিতে যোগ হওয়া নতুন এই তারকা যতবারই নজরে আসবে ততবারই মনে পড়বে এমি মার্টিনেজ কিংবা লিওনেল মেসিকে; মনে পড়বে জয়ের জন্য জীবন দিতে রাজি থাকা এক দল ফুটবলযোদ্ধাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link