৩৬০ ডিগ্রির সুরিয়াকুমার

আন্তর্জাতিক মঞ্চে আপনি প্রথমবারের মত ব্যাট করতে নেমেছেন; আর প্রথম বলটাই করবে সময়ের অন্যতম ইন ফর্ম বোলার। আপনি কি করতেন, নিশ্চয়ই চাইতেন বুঝে শুনে খেলতে। আপনি, আমি কি করতাম সেসব কল্পনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন সুরিয়াকুমার যাদব। ভারতের জার্সি গায়ে প্রথমবার বাইশ গজে নেমেই জোফ্রা আর্চারকে উড়িয়ে মেরেছেন বাউন্ডারির বাইরে।

যেন তেন ছয় না, এক পায়ে ভর করে ফাইন লেগ অঞ্চল দিয়ে স্কুপ করে একটা ছয়; একটা বার্তা। নতুন এক ধ্রুবতারা আবির্ভূত হওয়ার বার্তা। তবে সুরিয়াকুমার যাদব কতটা দুর্দান্ত সেটি সেই ছয় পুরোপুরি বোঝাতে পারেনি। ক্যারিয়ারের শুরুটা বাউন্ডারি হাঁকিয়ে করেছেন, আর এরপর ছুটতে শুরু করেছেন আরবীয় ঘোড়ার বেগে। তাঁকে ছোঁয়ার সাধ্য আছে ক’জনের?

টি-টোয়েন্টিতে ৪০ গড়ে ব্যাটিং করতে পারবে অনেকে, আবার ১৭০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করাও খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু দুটোই যদি একসাথে করতে বলা হয়? তাহলে নিশ্চয়ই অবিশ্বাস্য মনে হয়। আর এই কাজটাই করেছেন সুরিয়াকুমার যাদব। প্রায় তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার পরেও তাঁর ব্যাটিং গড় ৪৪ আর স্ট্রাইক রেট ১৮১ এর কাছাকাছি।

ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে অন্তত ২০০ রান করেছে এমন ব্যাটারের মাঝে সুরিয়াকুমার যাদব ছাড়া মাত্র চারজন করতে পেরেছেন এমন কীর্তি। তাঁরা হলেন তারানজিৎ সিং, জিসান কুকিখেল, ক্যান্ডেল কাডোওয়াকি-ফ্লেমিং এবং বিলাল জালমাই। এদের কেউ পরিচিত নয় কারণ তাঁরা খেলেন রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, জাপান আর অস্ট্রিয়ার হয়ে। অর্থাৎ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া দলগুলোর মাঝে একমাত্র সুরিয়াকুমারই পেরেছেন ১৭০ স্ট্রাইক রেট এবং ৪০ এর বেশি গড়ে ব্যাটিং করতে।

আর এমন ছন্দময় ব্যাটিংয়ের পিছনের রহস্যও বেশ পরিষ্কার। সুরিয়াকুমার যাদব মোটেও ব্যাটিংটাকে জটিল করে ভাবেন না। তিনি ক্রিজে আসেন; বোলারের ডেলিভারির লাইন লেন্থ বোঝার পরেই বলের লাইনে চলে আসেন। এরপর নমনীয় শরীর আর রিস্ট পাওয়ারের সাহায্যে খুঁজে নেন ফাঁকা জায়গা। আর পুরো কাজটা করতে সুরিয়ার কয়েক সেকেন্ডও লাগে না।

সুরিয়াকুমার যাদবের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা স্কয়ার লেগের পিছনে। অফ সাইডে অনেকটা বাইরের বলকেও সুইপ আর স্কুপ করে এই জায়গাগুলো দিয়ে পাঠাতে দক্ষ তিনি। এর জন্য তিনি বারবার পায়ের অবস্থান পরিবর্তন করেন, কখনো স্ট্যাম্প ছেড়ে অফ সাইডে সরে আসেন। এলোমেলোভাবে পা নাড়ান বা অফ সাইডের দিকে প্রসারিত করেন। জোফ্রা আর্চারকে মারা সেই ছয়টিই শেষ নয়, এরপর বহুবারই একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়েছিলেন এই ডানহাতি।

স্কয়ার লেগের পিছনের অঞ্চলের ক্ষেত্রে সুরিয়াকুমার যাদবের ব্যাটিং গড় ৫৬.৬৬ আর স্ট্রাইক রেট ৩০৬.৩। অর্থাৎ ঠিকঠাক লাইনে বল পেলে এক বলে তিন রানের বেশি নেন তিনি। ৩৬০° ব্যাটারের কথা ভাবলে সবার আগে স্কুপ শটের কথাই মাথায় আসে; সেটি এবিডি ভিলিয়ার্স যেমন করে দেখিয়েছেন সুনিপুণভাবে, তেমনি করে যাচ্ছেব সুরিয়া।

যখন থার্ড ম্যান অঞ্চলে খেলেন তখন সুরিয়াকুমার যাদবের ব্যাটিং গড় ৫৪.২০ আর স্ট্রাইক রেট ২০৩.৭৬। সব মিলিয়ে স্ট্যাম্পের পিছনে এই তারকার স্ট্রাইক রেট ২৫০ এর বেশি। রান করার ক্ষেত্রে স্কুপ বা সুইপের মত আপার কাট তাঁর বড় অস্ত্র। বল যখন কাঁধের উপর দিয়ে যায় তখন এই শট খেলেন তিনি। আবার স্ট্যাম্পের একটু উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বলটাও আপার কাট করার সামর্থ্য আছে এই ব্যাটারের; সেক্ষেত্রে শরীরকে বাঁকিয়ে প্রায় বেলের উচ্চতায় নিয়ে আসেন তিনি।

ধরুন আপনি বোলার, হার্ড লেন্থে বল করবেন স্থির করেছেন। সে হিসেবে লং অফের ফিল্ডারকে তুলে মিড অফে রেখেছেন, ভেবেছেন এই উচ্চতার বল অন্তত লং অফের উপর দিয়ে বাউন্ডারি মারতে পারবে না। কিন্তু ব্যাটার যদি হয় সুরিয়াকুমার যাদব তবে আপনার অনুমান ভুল; তাঁর প্রথম টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরির হাইলাইটস দেখলেই ব্যাপারটি বোঝা যাবে। ক্রিস জর্ডানের করা কোমর সমান উচ্চতার বল ফ্ল্যাট ব্যাটে হিট করেই লং অফের উপর দিয়ে ভাসিয়ে ছয় রান তুলে নিয়েছিলেন তিনি।

আবার ইয়র্কার বলকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের উপর দিয়ে বাঁকিয়ে মারা কিংবা শর্ট বলকে ডিপ মিড উইকেট অঞ্চল দিয়ে মারা সবক্ষেত্রেই দারুণ ৩২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। সুরিয়াকুমার যাদবের মত ক্রিকেটীয় শটগুলো আর কেউ কি খেলতে পারে না – এমন প্রশ্নে স্বীকার করতে হবে পারে অনেকেই, কিন্তু তাঁদের সবার চেয়ে নিখুঁত সুরিয়া। আর শট অ্যাকুরেসির এই পার্থক্যটাও বেশ বড়সড়।

আপনি যেভাবেই বল করুন, যেভাবেই ফিল্ডিং সাজান না কেন সুরিয়াকুমার যাদবের হাতে শট আছে; তিনি গ্যাপ খুঁজে নিবেনই। প্রতিনিয়ত সঠিকভাবে শট খেলার সক্ষমতা আরো বাড়িয়ে তুলছেন এই তারকা ব্যাটার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link