গুঞ্জনটা অনেকদিন ধরেই বাতাসে ভাসছিল; ক্লাব হীন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো হয়তো ইউরোপ ছেড়ে পাড়ি জমাবেন অন্য কোথাও। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে চুক্তি বাতিলের পর থেকেই বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ক্লাবে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন রোনালদো, কিন্তু সফল হননি। শেষ পর্যন্ত তাই বেছে নিতে হয়েছে বিদায়ের পথ।
গুঞ্জনকে সত্যি করে সৌদি আরবের প্রো লিগের ক্লাব আল নাসেরের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ৩৭ বছর বয়সী তারকার সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি করেছে তারা। রোনালদোর বার্ষিক বেতন হবে ৭৫ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ৭০০ কোটিরও বেশি। আর এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক ধারী ফুটবলারদের তালিকায় সবার উপরে উঠে এসেছেন তিনি। এছাড়া অন্য যে কোনো ফুটবলারের চেয়ে বার্ষিক আয়ও বেশি হবে রোনালদোর।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আল নাসেরে যোগ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবলে তাঁর পথ চলার সম্ভাব্য ইতি টেনেছেন। পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জয়ী রোনালদোকে হয়তো আর কখনো ফুটবলের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক মহাদেশে দেখা যাবে না। তবে বিদায় বলার আগে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ঠিকই প্রমাণ করেছেন তিনি; জিতেছেন রেকর্ড পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ১৪০ গোলও রয়েছে তাঁর দখলে।
এছাড়া প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা আর সিরি এ – তিনটিই লিগ শিরোপাই জিতেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। শুধু লিগ শিরোপাই নয়; লিগ কাপ, উয়েফা সুপার কাপ সহ ইউরোপের সম্ভাব্য সব ট্রফি নিজের করে নিয়েছেন তিনি। বর্ণিল এক ক্যারিয়ারে ইউরোপীয় ক্লাবের হয়ে ৭০১ গোল করেছেন রোনালদো; আর জাতীয় দলের হয়ে করেছেন ১১৮ গোল। উভয় ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড এই মহাতারকার দখলে।
এত এত রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও সময়টা একদমই ভাল যাচ্ছে না ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। নতুন মৌসুম শুরু হতেই রোনালদোর জীর্ণ-শীর্ণ রূপ প্রকাশ পায়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে চলতি মৌসুমে ইংলিশ লিগে মাত্র এক গোল করেছিলেন তিনি। পর্তুগালের হয়েও বিশ্বকাপে করেছিলেন একটি গোল পেনাল্টি থেকে। ক্লাব ও জাতীয় দলে বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে বেঞ্চে।
তবু ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ইউরোপে দেখতেই উদগ্রীব ছিল ভক্ত-সমর্থকরা। বিশ্বাস ছিল রোনালদো হয়তো ঘুরে দাঁড়াবেন নতুন কোন জার্সি গায়ে। কিন্তু সেই বিশ্বাস এবার আর বাস্তব হয়নি; বিদায় বলতে হয়েছে তাঁকে।
কাতার বিশ্বকাপের আগে পিয়ার্স মরগ্যানকে আলোড়ন সৃষ্টি করা এক সাক্ষাৎকার দেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। দাবি করেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এই সাক্ষাৎকারের জের ধরেই তখন ক্লাবের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় এই তারকার। এরপর আর নতুন কোন ইউরোপের ক্লাব না পাওয়ায় এশিয়ার ক্লাবেই চলে এসেছেন রোনালদো।
যার শুরু আছে, তার শেষও আছে – প্রকৃতির এই অমোঘ বাক্যকে সত্যি করেই শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছেন সিআরসেভেন। তবে একটা বিশ্বকাপ ছাড়া আক্ষেপ করার কিছু নেই তাঁর; একে একে সব অর্জন আর রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। প্রায় দুই যুগ নিজের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করেছেন ফুটবল বিশ্বকে। এবার ধীর পায়ে হেঁটে বিদায় নিচ্ছেন মঞ্চ থেকে, যেই মঞ্চে এক সময় তিনিই মাতিয়ে রেখেছিলেন।
কত কত হ্যাটট্রিক করেছেন, গোলপোস্টের বহুদূর থেকেই ফ্রি-কিকে গোল করেছেন। চ্যাম্পিয়স লিগের সবচেয়ে হাই ভোল্টেজ ম্যাচের নায়ক হয়েছিলেন। এসব কিছুই এখন অতীত; ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্টে আর দেখা যাবে না পর্তুগীজ যুবরাজকে; তাঁর ক্যালমা, ক্যালমা উদযাপন কিংবা আইকনিক সিইউউ দৃশ্যও আর উপভোগ করা যাবে না।
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি? জীবনানন্দ দাশের এই প্রশ্নের উত্তরই দিয়ে গিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ইউরোপীয় ফুটবলের আকাশ থেকে নিভে গিয়েছে রোনালদো নামক নক্ষত্র। এমন নিভে যাওয়া এই মহারথীর শেষের ইঙ্গিত-ই দেয়।