বিনোদনের এক ফেরিওয়ালা

২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর মহেন্দ্র সিং ধোনি রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আর কয়েক মাস থাকলে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে ফেলা যেতো।’

২০১১ ও ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের দু’দফা এমন ‘সুযোগ’ এসেছিলেন। প্রতিবারে দেড় মাস, দুই মাস ধরে ছিলো তারা বাংলাদেশে। একটা সময় এই একই স্যামি, গেইল, পোলার্ডদের মুখ দেখতে দেখতে মনে হতো, এরা আর বিদেশী খেলোয়াড় নন; বাংলাদেশেরই কোনো ক্লাব টিম হয়তো!

ড্যারেন স্যামি একেবারে পাড়ার বড় ভাইয়ের মতো হয়ে উঠেছিলেন।

রোজ ম্যাচশেষে, ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে আসতেন। রোজ একই ধরণের কথা, মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগতো। কিন্তু স্যামির অদ্ভুত কিছু ভঙ্গি আছে না? ওসব কারণে কখনো বিরক্তিকর মনে হতো না। প্রতিদিনই কিছু না কিছু করে হাসাতেন সবাইকে।

একটা কাজ রোজ করতেন।

কেউ কোনো অপছন্দের প্রশ্ন করলে ঠোট দুটো শিস দেওয়ার মতো করে গোল করে, জিহবাটা তালুতে ঠেকিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলতেন, ‘নু নু নু…’; মানে-নো, নো, নো। আমাদের এক অনুজ সাংবাদিক এই ‘নো, নো’টা প্রেসবক্সেও চালু করে ফেললেন। নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা করে প্রেসবক্সে, বাউন্ডারির বাইরে, আড্ডায় এক সময় সবাই ‘নো, নো, নো’ বলা শুরু করলাম।

একদিন আমি ওই শব্দটা করেছি।

বেশ দূর থেকে স্যামি হেটে আসছিলেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষের দিকে। আমার কাছে একে একটু দাঁড়ালেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, তোমরা আমাকে মক করো। সমস্যা নেই। আমিও তোমাদের মজা দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করেই এটা করি।’

একই সাথে লজ্জিত ও মুগ্ধ হলাম।

একটু জিভ কেটে অজুহাত দেওয়ার চেষ্টা করতেই একগাল হেসে বললেন, ‘তোমরা আনন্দ পাচ্ছ তো?’

সে আর বলতে!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের গাছপালা আশেপাশে থাকলেও মানুষ আনন্দ পায়। গেইল, ব্র্যাভো, স্যামিদের একটু চোখের ইশারা দেখলেও মানুষের কয়েক দিনের দুঃখ কেটে যায়। এক একটা খেলোয়াড় তো নন, এক এক পশলা সতেজ হাওয়া। আজকের নোংরা, প্রতিযোগিতা-সার, পয়সার দুনিয়ায় একই একটি মাত্র দল, যারা শরীরের চেয়ে বড় একটা করে হৃদয় নিয়ে ঘোরে।

এ হেন স্যামি একবার সংবাদ সম্মেলনে বড় দুঃখ করলেন।

ঘটনা হলো, ক্রিকইনফোতে একটা কমেন্ট্রি লিখতে গিয়ে ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস লিখেছেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের মস্তিষ্কে ঘাটতি আছে…’

এই কথাটায় বড় দুঃখ পেয়েছেন স্যামি। খুব কষ্ট নিয়ে বলেছেন, এমন অসম্মান আশা করেননি তিনি। নিজেদের অসম্মানের তীব্রতা বোঝাতে বলেছেন, ‘পশুরও তো মস্তিষ্ক থাকে। আমরা তো পশু নই; আমাদের নিশ্চয়ই আরেকটু সম্মান প্রাপ্য।’

মার্ক বিখ্যাত মানুষ। নামকরা সব জায়গায় ধারাভাষ্য দেন। তার কথায় ভুল ধরাটা আমার সাজে না। তিনি জ্ঞানী মানুষ। তার তুলনায় ক্যারিবিয় সাগরপাড়ের এই মানুষগুলো, বা এই আমরা একটু ‘বোকা-সোকা’ তো বটেই।

তাই বলে মানুষকে যে এমন করে বলা যায় না, এটুকু আমরা বুঝি।

প্রায়ই তো দেখি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রশংসা করার ছলে ওদের ভাড়াটে, বুদ্ধিহীন, পেশীনির্ভর; কতো কী বলা হয়। ক্লাইভ লয়েডদের মহামানব আর এই প্রজন্মটাকে তুচ্ছ একটা কিছু, বলতে একদমই পন্ডিতদের মুখে বাধে না।

সে তো আমরাও বুঝি যে, এটা ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, স্যার সোবার্সদের দল নয়। এই দলে সেই ত্রাস ফাস্ট বোলারও নেই। তাই বলে এদের মস্তিষ্ক বা হৃদয়ের ঘাটতি আছে, এমন কথা কী করে বলেন!

টানা তিনটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মধ্যে দুটিতে ফাইনাল খেলছে এই ‘বোকা-সোকা’ স্যামির দল। এই ফরম্যাটে প্রায় অপ্রতিরোধ্য এই দল। শুধু জোরে জোরে বল পিটিয়ে নিশ্চয়ই এই সাফল্য আসে না? মাঠে খেলায় জিততে গেলে সেটা ওই পেশীশক্তির সাথে নানাবিধ বুদ্ধি, স্কিল দিয়েই জিততে হয়। চেহারা দেখে কেউ ট্রফি দিয়ে দেয় না।

ফলে ‘কিছুটা’ মস্তিষ্ক যে আছে, সেটা মানা দরকার।

হ্যা, তর্কের খাতিরে পণ্ডিত মানুষদের সাথে একমত হয়ে বলি যে, মস্তিষ্কে এদের ঘাটতি আছে। ঘাটতি না থাকলে এতো হাসি আসে কোত্থেকে?

অন্য সব দলের যখন খেলার টেনশনে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়, আইপিএল-বিপিএল সমীকরণ কষতে গিয়ে রক্তচাপ বেড়ে যায়, বোর্ড-কমিটির জবাবদিহি নিয়ে ভাবতে হয়; এই ছেলেগুলো তখন কী করে অমন রাস্তা-ঘাটে নেচে বেড়ায়!

বাকী ক্রিকেটাররা যখন সিরিয়াস হয়ে মাঠের কথা ভাবে, এরা তখন ম্যাচ হেরেও কী করে আফগানদের সাথে গিয়ে নাচে!

এটা নির্বোধের লক্ষণ নিশ্চয়ই!

সে আমরা স্যামিদের নির্বোধ ভেবে তৃপ্ত থাকতে পারি। তাশের দেশের ইস্কাপন, রুইতনদের মতো মুখ শক্ত করে ভাবতে পারি, ওদের নিশ্চয়ই সমস্যা আছে। নইলে ওরা এমন কেনো? তবে একটা কথা জানবেন, ওদের কাছে একটা অনেক বড় জিনিস আছে, যা এই আমাদের কারো নেই: বিশাল একটা হৃদয়।

বাণিজ্যের আগ্রাসন, মিডিয়ার তেলেসমাতি, ফেসবুকের চিৎকার আর বহুজাতিক কোম্পানির চাপে পড়ে আমরা তো খেলাই ভুলে গেছি, আমরা হাসতেই ভুলে গেছি। আমরা বাংলাদেশীরা, ভারতীয়রা, পাকিস্তানীরা এখন কেবল টেনশনে দিন কাটাই। খেলাটা শেষ হয়ে গেছে।

সেখানে এই ক্যারিবিয়রা, টাকা নেই, বোর্ডের সাথে মিটমাট নেই; তারপরও বিশাল একটা হৃদয় নিয়ে হাসি বিলিয়ে বেড়ায় বছরের পর বছর। সমস্যার মধ্যেও স্যামির আছে এক আকন্ঠ হাসি!

স্যামিকে যারা এই সব কান্ড দেখে শুধু একজন ‘জোকার’ ভাবেন, তারা আসলে ভাবরাজ্যের বাইরে থেকে ঘুরছেন। স্যামি একজন চার্লি চ্যাপলিন; বাইরে বাইরে খুব কমেডিয়ান। বাইরে বাইরে এই হাসি বিলিয়ে যাচ্ছেন, ভেতরে ভেতরে দাঁড় করিয়ে যাচ্ছেন এক জীবনদর্শন।

এইসব মজা করতে করতেই ব্যাঙ্গ করেন ধ্বসে পড়া ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট কাঠামোকে। এইসব মজা করতে করতেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আজকের দিনের অতিপেশাদার, মুখ গোমড়া খেলাধুলার সংকটকে।

উদযাপন নিয়ে কথা বলতে বলতে একটু মুচকি হেসে বলেন, ‘এইসব মজা আসলে মানুষকে চাপ থেকে বের করে আনে। জীবনটাকে এতো সিরিয়াস করে ফেললে সাফল্য আসে না। ভেবে দেখুন, সেলফি তোলার সময় লোকে কতটা উৎফুল্ল থাকে! আমাদের ব্যাপারটিও তাই। আমরা খেলায় তো সবসময় ভালো অবস্থায় থাকি না। কখনো চাপে পড়ি, কখনো টানটান টেনশন হয়। তখন আপনারা সেলফি তুলে যে স্বস্তিটা পান, সেটাই পেতে চাই আমরা। এক এক সময় এক এক ধরণের সেলিব্রেশন করে বের হই।’

সেই ২০১১ আর ২০১২ সালের কথা বলছিলাম।

স্যামি রোজ দিন একটা করে কাণ্ড করতেন। কখনো হাঁটু ভাজ করে মুশফিকের সমান হওয়ার চেষ্টা করতেন, কখনো ট্রফিটা চুরি করার ভঙ্গি করতেন, কখনো সাংবাদিককে নকল করতেন।

একেবারে শেষ দিনটায় এসে একটু বলেছিলেন। তখন বাজারে জোর গুঞ্জন, স্যামি দল থেকে বাদই পড়ে যাবেন। শেষ দিনের সংবাদ সম্মেলনের শেষে বলছিলেন,

‘আমি আর কখনো অধিনায়ক হিসেবে, খেলোয়াড় হিসেবে হয়তো বাংলাদেশে আসবো না। তোমরা আমাকে মনে রেখো। আমি জানি, তোমরা আমাকে জোকার ভাবো। দ্যাখো, আমি তো লারা নই। আমি ব্যাটের জাদু দেখিয়ে ক্যারিয়ার শেষে বলতে পারবো না যে, ডিড আই এন্টারটেইন ইউ? তাই হাসিয়ে গেলাম। এখন বলতে পারি, ডিড আই এন্টারটেইন ইউ?’

অশ্রুসজল চোখে আমরা দাঁড়িয়ে করতালি দিতে দিতে বলেছিলা, ‘ইয়েস, ইউ ডিড।’

আজও বলি, স্যামি, আপনি এই সময়ের সবচেয়ে আনন্দদায়ী দলের অধিনায়ক। আপনার এক ফোটা মস্তিষ্কের দরকার নেই। মস্তিষ্কের হিসেব ইউরোপিয়রা করুক। আমাদের দরকার হৃদয়। আপনাদের মাপের হৃদয় আমরা আগে দেখিনি।

পৃথিবীর তাবৎ ক্রিকেট ভক্তের পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ। ইউ ডিড এন্টারটেইস আস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link