বয়সটা তো হয়ে গেছে চল্লিশ ছুঁইছুঁই।
টেস্টে ওপেনার হিসেবেই আছে খ্যাতি। সঙ্গে দশটি সেঞ্চুরি। কী ভেবেছিলেন, তিনি সীমিত ওভারের ক্রিকেট বাদ দিয়ে টেস্ট নিয়ে আছেন এবং অবসরের পরিকল্পনা করছেন? না, তিনি এই ২০২০ সালে এসে হয়ে গেছেন টি-টোয়েন্টির বড় তারকা!
এই সর্বশেষ ম্যাচটার কথাই ধরুন না। পুরো পাকিস্তান দল মিলে যেখানে করেছে ১৬৩। মোহাম্মদ হাফিজ সেখানে একাই করেছেন ৯৯; ছিলেন অপরাজিত। ক্যারিয়ারের এমন বেলাশেষে এমন করেও কিভাবে কেউ বদলে যেতে পারে? মানিয়ে নিতে পারে ‘ইয়াং ব্লাড’ দের খেলা বলে পরিচিত টি-টোয়েন্টিতে!
হ্যা, পেরেছেন মোহাম্মদ হাফিজ।
কিভাবে পেরেছেন? অনেকগুলো কাজ তিনি করেছেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, গলফ কোর্সে প্রচুর সময় দিয়েছেন। আর গলফ ক্লাবের সুইংই নাকি হাফিজকে ইদানিং ক্রিকেটের পাওয়ার হিটারে পরিণত করেছে!
২০২০ সালটাই টি-টোয়েন্টিতে মোহাম্মদ হাফিজকে নতুন করে চিনিয়েছে। অথচ বছরের শুরুতে হাফিজ দলেই ছিলেন না। টেস্ট থেকে তো অবসর নিয়েছেনই। বাদ পড়েছিলেন বিশ্বকাপের মাঝপথেও। শুধু কি তাই? তিনি তো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় চুক্তিতেও ছিলেন না।
বছরের শুরুতেই দুটো সিরিজ হেরে গেল পাকিস্তান; আবার ডাক পড়ল মোহাম্মদ হাফিজের। তবে সেই ডাক পড়ার কারণ যত বেশি না পারফরম্যান্স ছিল, তার চাইতেও বেশি ছিল দলে একজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের উপস্থিতি। অভিজ্ঞতা তো মিলেছেই। তবে হাফিজ এরপর আরো যা যা দিয়ে চলেছেন পাকিস্তান ক্রিকেটে। তা সম্ভবত মানেজমেন্ট প্রত্যাশাও করেনি।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এই বছর তিনি সপ্তম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। গড়ের হিসাবে এ বছরে তার চাইতে উপরে আছেন মাত্র তিনজন খেলোয়াড়। তবে এসবের চাইতেও নজর কাড়বে হাফিজের স্ট্রাইক রেট-১৩৮.৮৪! এই স্ট্রাইক রেট যে যেকোন নামী টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের চাইতেও বেশি!
টি-টোয়েন্টিতে এই বছর হাফিজের স্ট্রাইক রেটের মহিমা বোঝাতে একটা প্রসঙ্গ টেনে আনাই সুবিধাজনক হবে। হাফিজের স্ট্রাইক রেট এসব ব্যাটসম্যানের থেকে এ বছর বেশি-জনি বেয়ারেস্টো, ডেভিড ওয়ার্নার, বিরাট কোহলি, কেএল রাহুল, দাউইদ মালান, বাবর আজম,অ্যারন ফিঞ্চ, ফখর জামান!
এবার ভাবুন হাফিজের স্ট্রাইক রেটের মহিমা!
শুধু তিন নম্বরে নামা পারফর্ম্যান্স ধর্তব্যে নিলেও সেখানে হাফিজের ধারেকাছে কেউ নেই। ১৪২ এর ওপর স্ট্রাইক রেটে তিনি তিন নম্বরে ব্যাট করেছেন ৫০ এর কাছাকাছি গড়ে!
এমনিতেই বছরটা গেছে নির্জনতায়, মহামারী আতঙ্কে অনেকটা সময় আমরা সবাই থেকেছি ঘরে। ক্রিকেট থেকেছে নির্বাসনে। সেই নির্বাসনের বছরে ধুম ধাড়াক্কা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে হাফিজ ব্যাট করেছেন এমন সুরে, যে সুরের তাল লয় ছন্দ গাঁথতে হাফিজের তুলনা শুধু তিনিই। যে তুলনায় তিনি পেছনে ফেলেছেন তাবৎ সব নাম, টি-টোয়েন্টির সব হট কেক আর পেশীশক্তির জোর দেখানো সব ধ্রুবতারাদের! হাফিজের জন্যেও খুব সম্ভবত পুরো টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এমন বছর আর আসেনি।
তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকেই কিন্তু হাফিজের দিকে দৃষ্টি ছিল সবার। একজন অলরাউন্ডার যিনি কিনা ব্যাট করতে পারেন সাবলীলভাবে। আছে কার্যকরী স্পিন বোলিংয়ের টোটকা। হাফিজকে মনে করা হত তিনি টি-টোয়েন্টির জন্যে সঠিক বাছাই!
২০০৫-২০০৬ সালের দিকে ফিরে যাওয়া যাক। সে সময় পাকিস্তানে চলছিল ‘এবিএব আম্রো টি-টোয়েন্টি কাপ’ টুর্নামেন্ট। হাফিজ সে টুর্নামেন্টে খেলছিলেন ‘ফয়সালাবাদ উলভস’ এর হয়ে, ওপেনার হিসেবেই। সে টুর্নামেন্টে তিনি ব্যাট করেছিলেন ১৬৩.১৮ স্ট্রাইক রেটে, ৩৪.৩৫ গড়ে! শুধু কি ব্যাট হাতেই, হাফিজ নজর কেড়েছিলেন বোলিংয়েও। ৬.৫ এর নিচে ইকোনমিতে ২০ এর কম উইকেট ছিল তার ঝুলিতে। টি-টোয়েন্টিতে নাম করতে আর কী লাগে হাফিজের তখন!
এরপর এই দশকে যখন টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা চালু হয়ে গেল আন্তর্জাতিকভাবেই, হাফিজ তখনও পাকিস্তানের বড় ভরসার নাম। ২০১০ থেকে ২০২০, গোটা এক দশকে তিনি পাকিস্তান দলে ছিলেন নির্ভযোগ্য এক নাম। এ সময়টাতে অবশ্য সবসময়ই তিনি সেই ফয়সালাবাদ উলভসের মত বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারেননি, হাত খুলে ছড়ি ঘোরাতে পারেননি, তবে ওপেনিংয়ে নেমে পাওয়ারপ্লেতে জায়গা খুজে বাউন্ডারি হাঁকাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তবে গত এক দশকে যাই করে থাকুন না কেন, এই একটা বছরে তিনি সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছেন।
তবে শুরুর দিনের ওপেনার হাফিজ কিন্তু এই নিকট বছরগুলোতে আর ওপেনার নন। বেশিরভাগ সময়ে ব্যাট করেছেন তিন বা চার নম্বরে। মিডল অর্ডারে ব্যাট করলে যেটা হয়, স্পিন সামলানো লাগে আর তাতে রানও তুলতে হয় দ্রুত। তাতে প্রথমে কিছুটা আড়ষ্ট ছিলেন হাফিজ। ২০১৮ -২০১৯ তে তো তাঁর স্ট্রাইক রেট ১১৪ এর আশেপাশেই ছিল, এখনকার দিনে যে স্ট্রাইক রেট টি-টোয়েন্টি তে ‘চলনসই’ এর মাত্রাও ছোঁয় না। তবে সেই স্ট্রাইক রেট এ বছর লাফিয়ে উঠে গেছে ১৪৭-এ, বাউন্ডারি হাঁকানোতেও হাফিজের মুন্সিয়ানা দেখা গেছে বেশ। কিভাবে? মুখোমুখি হওয়া প্রত্যেক নয় বলের একটাতে যে হাফিজ বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন এ বছর।
আগেই বলেছি, হাফিজ এখন ব্যাট করেন মিডল অর্ডারে। অনেক সময়ই ডেথ ওভারগুলোতে তাকে উইকেটে থাকতে হয়। আর ডেথ ওভারে টি-টোয়েন্টি ফর্ম্যাটে সবচাইতে বড় খেলাটাই জমে ওঠে। এই বছর সেই ডেথ ওভারেই হাফিজের স্ট্রাইক রেট ১৭৪, বিগত দুই বছরে যেটা ছিল ১৪৯!
এখন এতসব কিছু হাফিজ কিভাবে ঘটালেন? শুধুই টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পরই টি-টোয়েন্টিতে এতটা প্রাণবন্ত আর সাবলীল হয়ে গেলেন? খুব সম্ভবত না!
তিনি একটা তাড়না অনুভব করেছেন। বিশ্বকাপের পর যখন বাদ পড়লেন, তাকে নিয়ে প্রখর সমালোচনা হচ্ছিল পাকিস্তানী মিডিয়াতে। তখনই তিনি এই তাড়নাটা পেয়েছেন। নিজের ব্যাটিংয়ে একটা বিবর্তন, একটা উপযোগী পরিবর্তন দরকার ছিল হাফিজের, তা সেই পরিবর্তনটা তিনি এনেছেন এই বছর। মাত্র একটা বছরের মধ্যে নিজের মানসিকতা, ব্যাটিংয়ে এই পরিবর্তন আনা হাফিজকে প্রশংসা না করে উপায় আছে!
হাফিজের খেলা যদি আপনি এখন দেখে থাকেন, দেখবেন ওর শট টাইমিংটা এখন একদম ঠিকঠাক হয়। ক্রিকেট ব্যাটে ‘সুইট সাউন্ড’ বলে যে ব্যাপারটা আছে সেটাই এখন পরিস্ফুটিত হয় ঠিকঠাক। এই টাইমিং দিয়েই তিনি হঠাৎ করে এ বছর হয়ে গেছেন পাওয়ার হিটার। টি-টোয়েন্টির খেলোয়াড় হওয়ার জন্যে যেটা সবচাইতে জরুরী।
তাছাড়াও তিনি এখন অন্য সব ফর্ম্যাটের খেলা ছেড়েছেন। টি-টোয়েন্টিতে মনোযোগ দেওয়াটাও এক্ষেত্রে কিছুটা সহায়ক তার জন্যে। নেটে সময় কাটিয়েছেন বেশি, পাওয়ার হিটিং এর চর্চা করেছেন, টাইমিং নিয়ে কাজ করেছেন। আরো একটা ব্যাপার তাকে বেশ সাহায্য করেছে- গলফ খেলা! এই সময়টাতে তিনি গলফ কোর্সে প্রচুর সময় কাটিয়েছেন। এতে তার জোরে মারার ক্ষমতা যেমন বেড়েছে, ব্যাট সুইংয়ের সক্ষমতাও তেমন বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলাফলটাও তো পরিষ্কার। অন্য সব বছরের চাইতে এবার তিনি ছয় মেরেছেন সবচাইতে বেশি(৩৭ টি), একটা ছয় মারার জন্যে বল খরচ করেছেন সবচাইতে কম। এই বছরের চাইতে তিনি আর মাত্র একটা বছরেই বাউন্ডারি হাঁকাতে এতটা সিদ্ধহস্ত ছিলেন আর তা ২০১০ সালে! মাঝের ওভারে পেস বোলিংয়েও হাফিজ এখন বেশ স্বচ্ছন্দ্য! ২০১৮-২০১৯ এ যেখানে তিনি মাঝের ওভারে পেস বোলিংয়ে ২৭১ বলে ১৯ টা ছয় আর ১১ টা চার মেরেছেন, এই বছরে ১২৬ বলে মেরেছেন ২৪ চার আর সাত ছয়- স্ট্রাইক রেট ১৬৮!
কিছু পরিসংখ্যান বলে যাই ‘৩৫ বছর বা তারচেয়ে বেশি বয়স, ৪৫ গড় আর ১৩৫ এর ওপর স্ট্রাইক রেট’ এই তিনটা প্যারামিটার মাথায় রেখে সেরা ব্যাটসম্যান নির্বাচন করতে বসলে হাফিজ থাকবেন তিন নম্বরে- ৮৬৫ রান, ৪৫.৫২ গড়, ১৩৮.৮৪ স্ট্রাইক রেট। তবে এক্ষেত্রেও একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, হাফিজের ওপরের দুইজন ব্যাটসম্যান হলেন ক্রিস গেইল ও এবিডি ভিলিয়ার্স। প্রথমত দুইজনই এই কীর্তি গুলো গড়ে চলেছেন অনেক অল্প বয়স থেকেই, দ্বিতীয়ত এরা দুইজনই ক্যারিয়ারজুড়ে টি-টোয়েন্টির বড় নাম, খেলাটাকে বোঝাতে তারা আজীবন সিদ্ধহস্ত। কিন্তু মোহাম্মদ হাফিজ কখনওই টি-টোয়েন্টিতে গেইল কিংবা ভিলিয়ার্সের সমকক্ষ বড় নাম ছিলেন না। এই হুট করে এই একটা বছরে তার পরিবর্তনটা নিয়ে তাই কথা বলতে হচ্ছে অনেক বেশি। ক্যারিয়ারের গোধূলীলগ্নে হাফিজ সেটা বলতে বাধ্যই করছেন!