ক্রিকেট ফেরত সুচিকিৎসক

দর্শকে ঠাঁসা স্টেডিয়ামের মধ্যে কানফাঁটা চিৎকারের মধ্যে ব্যাট করা। পুলিশী প্রহরার মধ্যে দ্রুত বাসে উঠে পড়া। জানালায় চোখ পড়লে দেখা যায় হাজার হাজার মুখ, প্রিয় খেলোয়াড়দের এক পলক দেখার অপেক্ষায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দাঁড়ানো। নিজের সিটের বিপরীতে বসে আছেন বাঁহাতি ব্যাটিং কিংবদন্তি কুমার সাঙ্গাকারা, একজন ক্রিকেটারের সেরা যাত্রাসঙ্গী, কারণ তিনি যে দারুণ একজন ক্রিকেট দার্শনিকও বটে। সংক্ষেপে ডা. ড্যানিয়েল হ্যারিসের আইপিএল অভিজ্ঞতা।

এই ‘ডাক্তার’ পদবীটা যে শুধু তাঁর পরিচয়ের শোভাবর্ধন করছে তা না। সাবেক এই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার অ্যাডিলেডের হাজারো প্রাণরক্ষায় নিজেকে সঁপেছেন।

মাস দুয়েক ধরে, বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররা যখন ঘরে বসে লাইভে আসছেন, কোভিড-১৯ এবং ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছেন, অন্যদিকে আরেক সাবেক ক্রিকেটার কোভিড-১৯ নামক অদৃশ্য শত্রুর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন।

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই ওপেনার এখন জরুরী বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে রোগীসেবা দিচ্ছেন। এই স্পোর্টসম্যান করোনাভাইরাস মোকাবেলার গত দুই-তিন মাসের ক্লান্তিহীন সফরের দিনগুলিকে ক্রিকেটের বদলে জীবনের চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন, রুগীর সুস্থতায় খুঁজেছেন বিজয়, কৌতূহল আর কৌশলের বাহারে এই যাত্রায় মোটেই হতাশ নন তিনি।

ব্যস্ততা গেছে ভয়ানক, রয়্যাল অ্যাডিলেড হাসপাতালের জরুরী বিভাগ এমন চাপে কখনোই পড়েনি।

তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে তাঁদের রাজ্যে অন্য জায়গার তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা কম, ইতালি কিংবা নিউইয়র্কের মত পরিস্থিতি হবার আগেই সামাল দেয়া গেছে। যেটা ডঃ হযারিসদেরই অবদান। ডা. হ্যারিস ক্রিকবাজকে বলছিলেন নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা। রোগীদের ভীতি নিয়ে। অন্য কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে।

তিনি বলেন, ‘তাঁরা যে অবস্থায় আসছিলেন, যে মানসিক অবস্থায় আসছিলেন, আমাদের নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না যে তাঁদের করোনা আছে কি নেই, আমরা ভরসা কিংবা ভয় কিছুই দিতে চাইনি। আমরা তাঁদের সেবা করেছি, অন্যদের থেকে সরিয়ে রেখে। কারণ আমাদের তো আমাদের নিজেদের কর্মীদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হতো। তবে আমার ভাল লাগছে তাঁদের জন্য কিছু করতে পেরে। আর আমি মনে করি আমাদের হাসপাতালও বেশ ভালভাবে ব্যাপারটি সামাল দিয়ে আমাদের জন্যে সম্মান বয়ে এনেছে। রোগীকে আইসিইউ পাঠানোর যন্ত্রণা দেবার আগেই আমরা তাঁদের সুস্থ করে তুলেছি। সরকারের সামাজিক দূরত্ব নীতিমালা এখানকার লোকজনকে অত গুরুত্বে না মানতে দেখলেও এটি এখানে অতটা ভয়াবহতা ছড়াতে পারেনি, যদিও এটি সত্যি ভয়াবহ।’

মেডিসিনে আগ্রহ হ্যারিসের আগে থেকেই ছিল, যখন তিনি রেডব্যাকের সব ফরম্যাটেই নিয়মিত খেলতেন। ২০১২ সালে অবসর নেবার আগে টি-টোয়েন্টির আগ্রাসী ওপেনার হিসেবে নামডাক ছিল এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের। ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ারটাও নেহাত মন্দ ছিল না। এক সতীর্থের দেয়া ডাকনাম ‘ডক’ কে একসময় নিজের চিন্তাচেতনায় লালন করতে শুরু করতে শুরু করলেন, আর অ্যাডিলেডের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে ইন্টার্ন হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিজেকে যুক্ত করার পরিকল্পনা করলেন।

তিনি বলেন, ‘আমি ক্রিকেট ছাড়ার পরপরই এই মহৎ পেশায় নিজেকে যুক্ত করতে একদম শূন্য থেকে কাজ শুরু করি। জরুরী বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পেতে আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি, প্রশিক্ষণ নিয়েছি। বর্তমানে, আমি যে পদে আছি, সেটি হলো ইমারজেন্সি কনসাল্টেন্ট। সময়টা কঠিন হলেও উপভোগ্য ছিল।’

তাঁর প্রথম লাইমলাইটে আসা বিগব্যাশ দিয়ে। ২০১০ পর্যন্ত পাঁচ সেশন খেলে ১৪৩ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করেছেন।
২০১১ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টিতে রয়েল চ্যালেঞ্জারস ব্যাঙ্গালুরের বিপক্ষে ৬১ বলে ১০৮ রানের দারুণ একটি ইনিংস সুযোগ করে দেয় ডেকান চার্জার্সের হয়ে আইপিএলে খেলার। ২০১২ আইপিএল আসর তাঁর কাছে এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা হয়ে আছে এখনো। ৪ ম্যাচে খেলতে পেরেছিলেন। এরমধ্যে শিখর ধাওয়ানের সাথে ৮৬ রানের একটা জুটি করেছিলেন। গড় ছিল ২৭.৭৫।

হ্যারিস বলেন, ‘দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। কমই খেলতে পেরেছি। তবে সে আসরে যেরকম ম্যাচ জেতা উচিত ছিল , ততগুলো জিততে পারিনি। তবে সেই ৯-১০ সপ্তাহ ছিল আমার ক্রিকেট জীবনের সেরা সময়।’

তবে হ্যারিসের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুটাও ছিল ডাক্তারি ক্যারিয়ারের মতই চ্যালেঞ্জিং।

১৯৯৯ সালে, ওয়াকার, সাকলাইন, মুশতাকদের পাকিস্তানের সামনে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল ১৯ বছর বয়সী হ্যারিসের। এরপর তিনি ২০১২ সালে ক্রিকেট ছাড়ার আগে ড্যারেন লেহম্যানের দলেও খেলেছেন আবার খেলে গেছেন হালের কেন রিচারডসন, ট্রাভিস হেডদের সাথে।

টি-টোয়েন্টি  একজন বিস্ফোরক ওপেনার কিভাবে কভিড-১৯ এর মত মহামারীর জরুরী টিমে নিজেকে মানিয়ে নিলেন, তা জিজ্ঞেস করতেই তিনি জোরে হেসে উঠলেন, ‘ব্যাপারটা টি-টোয়েন্টির সাথেই মানানসই। আপনি ওই ফরম্যাটে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্তেই প্রথার বাইরে অনেক শট নিবেন, যা স্ট্রাইক রেট বাড়াবে। তেমনই করোনা ভাইরাসের মত অজানা রোগে ওষুধ কাজ না করলে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা চারদিনের ক্রিকেটের মত না যে, রয়ে-সয়ে ভিত্তি বানিয়ে খেলার সুযোগ পাবেন।’

হ্যারিসের কাছে ডাক্তারি জীবন তুলনামূলক কঠিন।

‘কাজ শিখো, কাজ কর, বাড়ি যাও’ এই রুটিন ছাপিয়ে ডাক্তারদের প্রতিনিয়ত অনেকরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
নিজের মতের সপক্ষে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘আপনাকে অনেক কেসে দীর্ঘদিন আটকে থাকতে হতে পারে। ক্রিকেটে একটা ইনিংসকে বড় করে দেখানো সহজ, কিন্তু চিকিৎসায় আপনাকে শতশত জটিল রুগী সামলাতে হচ্ছে, বাসায় এসেও স্বস্তি পাচ্ছেন না, সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।’

তাঁর মনে পড়ে সেই উদ্ধার অভিযানের কথা, যেখানে তিনি দুর্ঘটনায় আহত রুগীদের উদ্ধার করতে কাজ করতে হয়েছিল।
স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পরে অন্য হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। তিনি বলছেন, ‘আপনি অবশ্যই এসব পরিস্থিতিতে অমন প্রতিকূল জায়গায় স্বস্তিবোধ করবেন না, যতক্ষণ না তাঁদেরকে সুস্থ করতে পারছেন এবং নিজের স্থলে ফিরতে পারছেন।’

আজকাল হ্যারিসের ক্রিকেট খেলা তাঁর পুত্রকন্যাদের সাথে উঠোনের খেলায় সীমাবদ্ধ।  তবে তিনি ফাঁকা পেলেই মাঠে নেমে পড়তে চান। চেষ্টা করেন এবং যখনই তাঁর ব্যস্ত কাজ তাকে অনুমতি দেয় তখন ক্রিকেটে নামেন। যদিও তার যোগ্যতা এখন ‘ডানহাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘এমবিবিএস, এফএসিইএম, সিসিপিইউ’ এর মত ডিগ্রিতে পরিণত হচ্ছে , তবে তিনি তাঁর দুই প্রিয় পরিচয়ের মাঝে একটা পরিসীমা রাখতে সফল হয়েছেন।

তিনি বলছিলেন, ‘মনে হয় যে অনেকদিন আগে আমি খেলছিলাম। আমি এখনও খেলি, পরাস্ত হই। ক্রিকেট নিয়ে তাদের গল্প শুনে আনন্দ নেই। আনন্দিত। ক্রিকেটে আমি অনেক কিছুই শিখেছি যা এই চিকিৎসক জীবনেও কাজে লাগছে। ক্রিকেটের মত আমরাও একটা দল হয়ে কাজ করি, পরিকল্পনা করি এবং সাফল্য উদযাপন করি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link