১৩ আগস্ট, ২০২২। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা।
এইরকম একটা গরমের সন্ধ্যে। লিগের দ্বিতীয় ম্যাচ। অ্যাওয়েতে সামনে ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের এক বৎসর পুরনো ঘর ব্রেন্টফোর্ড। ম্যাচের শুরুতে ২-০। রোনাল্ডোর আস্ফালন, ডি গিয়ার আপাদমস্তক হতাশা আর টেন হ্যাগের সোজা হেঁটে বেরিয়ে যাওয়া। সমর্থকরা দেখছে। দেখছি আমি। ফোন তুলিনি কারোর। এক মুহূর্তে পরিবার তুলে গালাগালের সামান্য মেসেজ ভেসে এল। মিথ্যে বলা হবে যদি বলি, সেদিন ছাদে গিয়ে একটু হলেও চোখ ভিজে আসেনি। সমর্থকরা ক্লাবের জন্য বনস্পতির ছায়ার মতন।
সেদিন কড়কড়ে তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। ম্যাচ শেষে নিশ্চুপ ঘরে মিউট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিলাম। শেষ আট বছরেও তবে ছবি পাল্টাল না! ডেভিড মোয়েস থেকে মোরিনহো, ওলে, ফান গল কেউই পারল না যখন, নতুন টেন হ্যাগও তাদের দেখানো পথেই হাঁটলেন। সেই একই বহু চেনা ছবি। ম্যাচের পরে হতাশ চোখমুখ, ‘একদিন হবে’ বলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানো ছাড়া কোনও কর্তব্য নেই। কবে হবে, কখনও যে হবে এমন প্রতিশ্রুতি নিজের কাছে হাস্যাস্পদ হতে শুরু করেছিল ২০১৭-১৮ থেকেই।
অতি কষ্টে আয়াক্সকে হারিয়ে ইউরোপা এসেছিল শুধু দুটো প্লেয়ার, হুয়ান মাতা আর আন্দ্রে হেরেরার জন্য। আচমকাই ওই টুর্নামেন্টে বহুগুণে ভাল খেলেছিল হেরেরা। তারপর শুধুই হতাশা। কখনও দ্বিতীয়, কখনও তৃতীয়, ষষ্ঠ, ইউরোপা ফাইনালে দে গিয়ার পেনাল্টি মিস।
সাউদাম্পটনকে ৯ গোল। চলছিল, এক রকম চলছিল। ইউরোপে প্রতিষ্ঠিতরা ধারপাশ দিয়েও যেত না ক্লাবের। না শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ক্লাব অফিসিয়ালসরা। এবং অনেক অপ্রতিষ্ঠিত প্লেয়ারকে টেনে এনেছিল ক্লাবে। ফল, যে কে সেই। শেষ ছ’বছরে কোনও ট্রফি নেই। কোনও আনন্দ ভীড় করে না লাল দুর্গে।
স্বাভাবিকভাবেই ব্রেন্টফোর্ড ম্যাচের হতাশা, রাগ বাঁধ ভেঙে দিয়েছিল লিভারপুল ম্যাচে। চিৎকার করেছিলাম গভীর রাতে। শুনুক, জেগে উঠুক পাড়াপড়শী। টেকনিক্যালিটি, বিশ্লেষণ সব চুলোর দোরে যাক! আমি চেঁচাব। কাল থেকে আমায় তাড়িয়ে দিলেও কিছুমাত্র আক্ষেপ থাকবে না। আমরা জিতেছি। লিভারপুলকে হারিয়ে তিনটে পয়েন্ট ঘরে তুলেছি। দ্বিতীয় ম্যাচের পরে ২০ নম্বর দলের নাম ছিল আমার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আজ কোথায়, সেই মুখগুলো?
খুঁজিনি, বিশ্বাস করুন। খুঁজতে মন চায়নি। চেয়েছে শুধুই শান্তি। মুখে প্রশস্তির হাসি। মনে শান্ত নদীটির মত বিশ্বাস। ম্যানচেস্টার এখন জেতার অভ্যাসে। আগের গোটা সিজনে ৫ গোল করা রাশফোর্ড শেষ ১৭ ম্যাচে ১৬ গোল করেছে। এখন ব্রুনো আউটস্টেপে অ্যাসিস্ট করে। কাসেমিরো নামলে হালে পানি পায় না অপরপক্ষের মিড করিডর। ভারান-লিসান্দ্রো না থাকলেও ডিফেন্সে ভরসা যোগায় লিন্ডেলফ আর লুক শ’। বাদের খাতায় পড়ে যাওয়া ভ্যান বিসাকা ফিরে পেয়েছে জীবন।
ছোট ছেলে আলেহান্দ্রো গের্নাচো মাঠে বল পায়ে ডান্স করে। ইনস্টেপ-আউটস্টেপে ভিশন ঘুরিয়ে টেনে নিয়ে দৌড় করায় টাচলাইন পর্যন্ত। দে গিয়া হাসে। হাসতে হাসতে পার করে দেয় ক্লাবের সর্বোচ্চ ক্লিনশিটের রেকর্ড। আমার ম্যাঞ্চেস্টারে এখন সবাই হাসে। যেথায় হাসতে ভুলে গিয়েছিল পাগলগুলো। হতাশ মুখের পটচিত্রই ছিল যাদের নিত্যসঙ্গী। একদিন তো সবারই দিন আসে, তাই না? সারি সারি পাবলিশার্সের ভীড়ে একদিন তো কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথও বলে ওঠে, আমিই সুলতান!
ছন্দ। একটা ছন্দ, ছন্দের রাত, রাতের তারা, তারার হাসি। ঐ হাসির জন্য কতকাল অপেক্ষা করে থেকেছি। কত কাল ঘুমোতে যাওয়ার আগে একবার ভেবেছি, পরের দিন ঠিক জিতব। কম্পিটিশনের নোংরা, কালো ধোঁয়ার ভেতর সকলে এক টুকরো জীবনের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়।
এরিক টেন হ্যাগ নামক জিনিয়াসটি চুপিসাড়ে নিজের কাজ করে যান অক্লেশে। সমর্থকরা জানে। টানাটানির যুদ্ধে কেউ যখন দড়িটা ধরেনি একদিক থেকে তখন, পারলে তিনিই পারবেন। একটা বিশ্বাস। অনেক দিন পর ফিরে এসেছে স্বপ্নের থিয়েটারে। আর যেতে দেব না।
ভালবাসাকে যেতে দিতে নেই। জাপটে ধরাতেই প্রচ্ছন্ন শান্তি।