বুকের লকেট থেকে মুচকি হাসেন, আমারই ঈশ্বর!

সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ এর পরেই বোঝা গেছিল ওয়ান ডে তে দুশো করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। পুরো পঞ্চাশ ওভার যদি কোনো আক্রমণাত্মক ওপেনিং ব্যাটসম্যান টিকে থাকেন, তাহলে হতেই পারে। কিন্তু তারপরেও তেরো বছর অনেকেই কাছাকাছি এসেও এভারেস্টের শৃঙ্গ জয় করতে পারেননি।

সৌরভ গাঙ্গুলি ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ১৮৩ করার সময় আশা জাগিয়েছিলেন, কিন্তু শেষের দিকে পরপর উইকেট পড়তে থাকায় স্ট্রাইক পাননি। শচীন টেন্ডুলকার নিজে ১৮৬* করেন একবার, পুরো ওভার ক্রিজে থেকেও শেষদিকে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় বিগ হিট নিতে পারেননি। এরপরে জিম্বাবুয়ের চার্লস কভেন্ট্রি, আনোয়ারকে স্পর্শ করলেও পেরিয়ে যেতে পারেন নি। কিন্তু, এত ব্যাটসম্যানের মধ্যেও আমার সবসময় মনে হতো, ২০০ করলে শচীনই করবেন প্রথম।

কেন? – কেননা পুরো ৫০ ওভার বা তার কাছাকাছি সময় ক্রিজে থাকতে হলে শুধু মেরে চললেই হবেনা, ভালো বল যেগুলো আসবে সেগুলো সামলানোর মত, এবং দীর্ঘসময় ধরে সামলানো এবং খারাপ বা মধ্যম মানের বলগুলোকে বাউন্ডারি মারার মত স্কিল ও টেকনিক থাকতে হবে, তার সাথে আক্রমণাত্মক খেলা। এই দুয়ের সমন্বয় সচিনের খেলায় যতটা দেখেছি সেই সময়ে আর কারুর খেলায় দেখিনি। ২০০৬ এর জোহানেসবার্গ রান ফেস্টে পন্টিং বা গিবস, টিকে গেলে যে কেউ ২০০ করে ফেলতে পারতেন।

কিন্তু হয়নি। শচীন কিন্তু বারবার কাছাকাছি এসেছেন। চেস করে ১৭৫, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। নিউজিল্যান্ডের সাথে ৪৫ ওভারে তলপেটের পেশীর চোটে অবসর নেওয়ার আগে ১৬৩*, আর খান পনেরো বল যদি খেলতে পেতেন সেই সময়?

এরপরেই শচীন একটা মন্তব্য করেন, যে তিনি অন্তত আরেকটা ম্যাচ পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলতে চান। ডাবল সেঞ্চুরির কথা কিছু বলেননি, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, চোটের জন্যে তিনি যে ডাবল টা মাঠে ফেলে এলেন, সেটা তিনি নিজেও বুঝেছিলেন, আর নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন একটা শেষ যুদ্ধের জন্যে।

প্রায় ৩৭ ছুঁই ছুঁই বয়সে একজন ব্যাটসম্যান যাঁকে গোটা বিশ্ব বর্তমান প্রজন্মের সেরা এবং ডন ব্র্যাডম্যানের পরে অনেকে যাকে সর্বকালের সেরা মনে করেন, তিনি চাইছেন নিজেকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে। তিনি চান, অবসর নেবার আগে ওয়ান ডে তে এমন কিছু একটা করে যেতে, যা আগে কেউ কোনোদিন করে দেখাতে তো পারেন নি বটেই, ভেবেছেন বলেও অন্তত প্রকাশ্যে জানা নেই।

এরপরেই আসে সেই ঐতিহাসিক ২৪ ফেব্রুয়ারি। ২০১০ এর আগে অবধি দিনটি শুধুই আমার বাবার জন্মদিন হিসেবে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন ছিল। এদিন সচিন নতুন পালক যোগ করলেন তাঁর মুকুটে।

পিচ কেমন ছিল, বোলিং কেমন ছিল, মাঠ কেমন ছিল, সব আপনারা জানেন। খালি এটাই বক্তব্য, যে এর আগেও ছোট মাঠ, পাটা পিচ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে অনেক দুর্বল বোলিংয়ের বিরুদ্ধে অনেকেই খেলেছেন।

আমরা সবাই জানি, শচীনের সেরা খেলাটা বেরিয়ে আসে যখন বিপক্ষ তাঁকে কোনো কারণে রাগিয়ে দেয়। চামিন্ডা ভাস বলেছিলেন সচিন স্ট্রেট ড্রাইভ মারতে গেলে মিড অফএ ক্যাচ তোলেন। পরেরদিন ভাস কে স্ট্রেট ড্রাইভ কাকে বলে, কী ও কেনো – তার ক্লাস নেওয়া হয়েছিল। ওলঙ্গা বলেছিলেন সচিনকে গুডলেন্থ থেকে বুকের হাইটে বল তুললে তিনি স্লিপ বা গালিতে ক্যাচ দেবেন, এটাই তাঁর দুর্বলতা। পরের দিন শর্ট বলে কিভাবে থার্ডমান থেকে স্কোয়ার লেগ দিয়ে বাউন্ডারি ওভার বাউন্ডারি মারতে হয় তার লেসন চলেছিল।

এরকম উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবেনা। তবে গোয়ালিয়র এর ম্যাচের আগের ওয়ানডেতে জয়পুরে দক্ষিণ আফ্রিকা ২৯৮ রান তাড়া করে অনেক কাছাকাছি গিয়ে মাত্র ১ রানে হেরে যায়। সচিন একটা খুব ক্লোজ বাউন্ডারি বাঁচান, যেটা টিভি ক্যামেরায় দেখে বোঝা যায়নি সচিনের পা বাউন্ডারি লাইন ছুঁয়েছে কিনা। দক্ষিণ আফ্রিকা দাবি করে, শচীন বাউন্ডারি লাইন ছুঁয়েছিলেন, ওটা বাউন্ডারি এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে অন্যায়ভাবে হারানো হয়েছে। সচিনের সততা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ছিল এটা; এবং সচিন, স্বাভাবিকভাবেই এটা ভালোভাবে নেননি।

ওই একটা বাউন্ডারির বদলে পরের ম্যাচে গুনে গুনে ২৫ টি বাউন্ডারি আর তিনটি ওভারবাউন্ডারি গিলতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। যেমন মাস্টার করে থাকেন। বড়ে আরাম সে !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link