অনেকটা অভিমান করে বিদায় বলেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটকে। টি-টোয়েন্টিতে অধিনায়কত্ব হারানোর পরের সিরিজেই দল থেকে বাদ পড়েছেন। এবার বাদ পড়লেন ওয়ানডে দল থেকেও। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফুলস্টপও এতে পড়ে গেলো কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। কিন্তু কি কারণে রিয়াদের ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়া? গত দুই সিরিজে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহককে কেনই বাদ দিতে হলো ওয়ানডে দল থেকে?
কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু অনেকটা অনুমিতই ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজই হতে যাচ্ছে রিয়াদের জন্য এসিড টেস্ট। চান্দিকা হাতুরুসিংহে কোচ হয়ে আসার পর ‘আন্ডার পারফর্ম’ করা সিনিয়র ক্রিকেটারদের ওপর যে খড়গ নেমে আসতে যাচ্ছে সেটি বোঝাই যাচ্ছিল।
সেই অ্যাসিড টেস্ট উৎরাতে পারেননি রিয়াদ। গত ছয় মাসে দুটি ওডিআই সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। ভারত ও ইংল্যান্ডের সাথে খেলা এই দুই সিরিজের ছয় ম্যাচ মিলিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের নাম মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
এই ছয় ম্যাচে ৩৬.৮৩ গড়ে এবং ৮৫.০০ স্ট্রাইকরেটে সাকিবের ২২১ রানই সর্বোচ্চ। এরপরই ৩০.৩৩ গড়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সংগ্রহ ছিল ১৮২ রান। কিন্তু আলোচনার জায়গাটা স্ট্রাইকরেটে। এই ১৮২ রান রিয়াদ করেছেন ৬৯.২০ স্ট্রাইক রেটে। আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটের সাথে সেটা বেশ বেমানানই বলা চলে। শুধু তাই নয়, গত দুই সিরিজে ১০০ এর ওপর রান করা বাংলাদেশী ব্যাটারদের মধ্যে ৫৯.৩৪ স্ট্রাইক রেটে সবচেয়ে বাজে স্ট্রাইক রেট মুশফিকুর রহিমের। এরপরই আছে মাহমুদউল্লাহর ৬৯.২০ স্ট্রাইক রেট।
এখন প্রশ্ন হল মাহমুদউল্লাহর স্ট্রাইক রেট কতটা বাজে? বাংলাদেশের দলের কথা মাথায় রেখে এবং এই দুই সিরিজের চারটি ম্যাচই যেখানে হয়েছে সেই মিরপুরের উইকেটের কথা মাথায় রেখে কি রিয়াদের পারফরম্যান্স আসলেই বিলো এভারেজ? এটা সত্য যে, মাহমুদউল্লাহ যখনই ব্যাটিংয়ে আসেন তখনই দল থাকে বিপদে, তাকে ইনিংস পুনঃগঠণের দিকে মনোযোগ দিতে হয়। বিশেষ করে গত দুই সিরিজের বেশিরভাগ সময়ই বাংলাদেশের টপ অর্ডার ছিল ব্যর্থ। তাই ব্যাটিংয়ে নেমে বিপর্যয় সামাল দিতে হয়েছে রিয়াদকে।
কিন্তু রিয়াদ ব্যর্থ যে জায়গাটায় সেটা হলো এই বিপর্যয় সামাল দিতে গিয়ে কি তিনি দলকে জয়ের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারছেন কিনা। এক্ষেত্রে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে উদাহরণ টেনে আনা যাক। ১৮৭ রান তাড়া করতে নেমে দল যখন ৯৫ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে তখন ক্রিজে আসেন রিয়াদ।
দলের ছয় নম্বর ব্যাটার হিসেবে তখন তাঁর দায়িত্ব ছিল দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়া। কিন্তু ৩৫ বলে ১৪ রানের ইনিংস খেলাটা না যতটা ব্যর্থতার তার চেয়ে বেশি ব্যর্থতা হলো দলকে তখন আরো বিপদে ফেলে আউট হয়ে যাওয়া। প্রায় ৪০ স্ট্রাইক রেটে রান করে আউট হয়ে দলকে আরো হারের মুখেই ঠেলে দিয়েছিলেন অনেকটা।
এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে অবশ্য রান পেয়েছিলেন রিয়াদ। ৯৬ বলে ৭৭ রানের ইনিংসকে পারফেক্ট না বলা গেলেও কার্যকরী নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এরপর সদ্য সমাপ্ত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেও প্রায় একই ঘটনা। প্রথম ওয়ানডেতে ৪৮ বলে ৩১ রান করে আউট হন রিয়াদ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৩২৭ রান তাড়া করতে নেমে রিয়াদ করেন ৬৫.৩০ স্ট্রাইক রেটে ৪৯ বলে ৩২ রান। ইনিংসের শুরুতে কিছুটা সময় নেয়া মোটেই দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই সময় নেয়াটা দোষের হয়ে দাঁড়ায় যখন একজন ব্যাটার ইনিংসের শেষে সেটা পুষিয়ে দিতে না পারেন।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ সেই পুষিয়ে দিতে পারেননি। দুই একটা ব্যতিক্রম বাদে প্রায় প্রতিবারই প্রথম একের পর এক ডট বল খেলে সেট হয়ে তারপর আউট হয়ে গেছেন যখন দল তাঁর কাছে দ্রুতগতিতে রান চেয়েছে। সেটা শুধু গত দুই সিরিজ নয়, গত প্রায় দেড় বছরের ওয়ানডে ক্রিকেটের পরিসংখ্যান ঘাটলেও একই চিত্র বের হয়ে আসে। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেবার সময় নিশ্চিতভাবেই এই পরিসংখ্যান গুলো বারবার আলোচনায় এসেছে।
২০১৫ বিশ্বকাপের আগে কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেই লোয়ারঅর্ডারে ব্যাট করা রিয়াদকে সেট করেছিলেন চার নম্বর পজিশনে। সেখান থেকেই যেন ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় রিয়াদের। ২০১৫ বিশ্বকাপে তাঁর অবিস্মরণীয় দুটি সেঞ্চুরি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ। এরপর দলের প্রয়োজনে আবারো ছয় নম্বর পজিশনে সেট হতে হয় রিয়াদকে।
এই পজিশনেও দলের নির্ভরতার প্রতীক ছিলেন বহুদিন ধরে। কিন্তু বয়সের ভার হোক অথবা অন্য কোনো কারণ, রিয়াদের ফর্ম পড়তির দিকে বেশ কিছুদিন ধরেই। সেই সাথে যোগ হয়েছে গত কয়েকটা সিরিজ ধরে রিয়াদের বাজে ফিল্ডিং। একের পর এক ক্যাচ মিস আর গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে ব্যর্থতাও নিশ্চই বাদ পড়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো রিয়াদের বিকল্প কে? বেশিরভাগের কাছে উত্তরটা খুব সহজ। তৌহিদ হৃদয়। কিন্তু একাদশে রিয়াদের জায়গায় সুযোগ পেলে টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স দিয়ে ওয়ানডে দলে সুযোগ পাওয়া এই তরুণ ব্যাটার দলের মহাগুরুত্বপূর্ণ ছয় নম্বর পজিশনে কতটা ভালো করেন সেটিই দেখার বিষয়। এছাড়াও দলে ফেরানো হয়েছে ইয়াসির আলী রাব্বিকেও। আগের সিরিজে দল থেকে বাদ পড়া রাব্বি আবার কোনো পারফর্ম না করেই ফিরেছেন ওয়ানডে দলে।
এ বছরই ৩৮ এ পা দিতে যাচ্ছেন রিয়াদ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাই আবারো ফিরে আসাটা আপাতত বেশ কঠিনই। তারওপর এবছরের শেষভাগেই আছে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। তাই আয়ারল্যান্ড সিরিজের দল থেকে বাদ পড়া মানে বিশ্বকাপের পরিকল্পনা থেকেই অনেকটা ছিটকে পড়া। কিন্তু ক্রিকেটে তো শেষ বলে কিছু নেই। সামনের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে যদি অতি মানবীয় কিছু করতে পারেন! সেটিই আপাতত বিশ্বকাপ দল এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার জন্য রিয়াদের লাইফ লাইন বলে মনে হচ্ছে।