৩৫ বছর কেটে গেলো!

ক্রিকেট অনেক সময় জীবনের গল্প বলে। ক্রিকেট অনেক সময় জীবন্ত গল্প বলে।

কয়েক যুগ ধরেই এই ক্রিকেট আমাদের সবাইকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। বছরের পর বছর আমাদের এক সাথে যেমন হাসিয়েছে তেমনি এক সাথেই কাঁদিয়েছে। ১৯৯৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জয়ের পর দেশ জুড়ে আনন্দ আর ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে হারের পর কান্না সবই আমাদের এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছে।

১৯৮৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পর আমরা ইতোমধ্যে খেলে ফেলেছি ৩৭৬ টি ওডিআই। ১১৯টি টেস্ট এবং ৯৬টি টি-টোয়েন্টি। আরো একটি বছর শেষের পথে। দেখা নেওয়া যাক কেমন ছিলো আমাদের এই ৩৫ বছরের পথচলা। কেমন ছিলো আমাদের সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প গুলো।

ওডিআই

গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলেছে ৩৭৬ টি। ৩৭৬ ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ১২৮ ম্যাচে। কোন ম্যাচ টাই হয়নি; হেরেছে ২৪২ ম্যাচে। ফলাফল হয়নি ৭ ম্যাচে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৩৩৩। সর্বনিম্ন সংগ্রহও বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রান। সর্বোচ্চ ৩১৯ রান তাড়া করে জয় পেয়েছিলো বিশ্বকাপেই। এই সময় বাংলাদেশের হয়ে ওডিআই খেলেছে ১৩৩ জন ক্রিকেটার।

৭২০২ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল ও ২৭৬ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি মাশরাফি বিন মর্তুজা। সর্বোচ্চ ১৭৬ রানের ইনিংস এসেছে লিটন দাসের ব্যাট থেকে। ২৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে সেরা বোলিং ফিগারের মালিক যৌথ ভাবে মাশরাফি ও রুবেল হোসেন। ৬৪ টি ক্যাচ ধরে শীর্ষে মাহমুদউল্লাহ। সর্বোচ্চ জুটি লিটন দাস ও তামিম ইকবালের ২৯২ রান।

ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে খুব সহজেই ৪ টি ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৮৬ সালে অভিষেকের বছর থেকে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত এবং ২০১৫ এর পর থেকে বর্তমান।

১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত  সময়টা বাংলাদেশ ক্রিকেটের শিশুকালই বলা চলে। এই সময়ে কালভেদে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেতো বাংলাদেশ। এই ১৪ বছরে মাত্র ৩৫ টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এই ৩৫ ম্যাচে মাত্র ৩ টি জয় পেয়েছিলো বাংলাদেশ। অভিষেকের ১১ বছর পর নিজেদের ২৩ তম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৭ সালে ১ম আন্তর্জাতিক ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। এরপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে হারায় টাইগাররা।

১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সালের সময়টা সবচেয়ে কঠিন ও লজ্জাজনক ছিলো বাংলাদেশের জন্য। এই সময় টানা ৪৭ ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। টানা ৫ বছর জয়হীন ছিলো দেশের ক্রিকেট। এই সময়ে হওয়া ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের।

৫ বছর পর ২০০৪ সালেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় দিয়ে জয়ের খড়া কাটায় বাংলাদেশ। ২০০৪ থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত এই ধাপটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এই সময়েই বাংলাদেশ বড় দল গুলোকে হারাতে শেখে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পঞ্চপান্ডবের ৪ জনই দলে আসে এই সময়। এই ১১ বছরে বাংলাদেশ ওয়ানডে খেলে ২০৪ টি। ২০৪ ম্যাচে ৮১ টি জয় পায় বাংলাদেশ। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলংকা, নিউজিল্যান্ড সব দলের সাথে জয় আসে এই ধাপে। এই সময়টাতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৩০ ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ।

২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকেই বদলে যায় বাংলাদেশ। বিশ্ব ক্রিকেটে এই সময়েই অন্যতম পরাশক্তি হয়ে ওঠে টাইগাররা। বিশ্বকাপে ১ম বারের মতো কোয়াটারফাইনাল খেলার পর ঐ বছরই পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। এছাড়া জিম্বাবুয়ের সাথে ৩ টি ও আফগানিস্তানের সাথে ১ সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। দুই বার এশিয়া কাপের ফাইনালেও খেলে বাংলাদেশ। এই সময়ে খেলে ৮১ ম্যাচের ৪৩ ম্যাচেই জয় পায় বাংলাদেশ।

টেস্ট

২০০০ সালে অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত ১১৯ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। ১১৯ ম্যাচে ৯৬ জন ক্রিকেটারকে মাঠে নামিয়েছে বাংলাদেশ। ১১৯ টেস্টে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে মাত্র ১৪ ম্যাচে, ড্র করতে পেরেছে ১৬ টি ম্যাচ ও হেরেছে ৮৯ টি ম্যাচে। সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ৬৩৮ ও সর্বনিম্ন সংগ্রহ ৪৩।

৪৪১৩ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক মুশফিকুর রহিম। এক ইনিংসে সর্বোচ ২১৯ রানও এসেছে মুশফিকের ব্যাট থেকেই। ২১০ উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী সাকিব আল হাসান।

অভিষেকের পর থেকেই টেস্টে বিবর্ণ বাংলাদেশ। অভিষেকের ৫ বছর পর নিজেদের ৩৫ তম ম্যাচে এসে জিম্বাবুয়ের সাথে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। এরপর জিম্বাবুয়ের সাথে আরো ৬টি ম্যাচ জেতে টাইগাররা। জিম্বাবুয়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪টি টেস্ট জেতে বাংলাদেশ। এছাড়া শ্রীলংকা, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে ১ টি করে টেস্ট জেতে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে দেশের বাইরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়, ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার মতো পরাশক্তির বিপক্ষে টেস্ট জয় এবং নিজেদের শততম টেস্টে শ্রীলংকার মাটিতে শ্রীলংকার সাথে জয় বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসকে একটু হলেও সমৃদ্ধ করেছে।

টি-টোয়েন্টি

২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টি-টুয়েন্টি খেলার পর আরো ৯৫ টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। এই ৯৬ ম্যাচে ৩২ টি জয়ের বিপরীতে হারতে হয়েছে ৬২টি ম্যাচ। ফলাফল হয়নি ২টি ম্যাচে। দেশের হয়ে এই ফরম্যাটে ১৭৫৮ রান নিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবাল। সাকিব আল হাসানের ঝুলিতে সর্বোচ্চ ৯২ উইকেট।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের যাত্রাটা হয়েছিলো দারুণ ভাবে। প্রথম ৪ ম্যাচেই ৩ টি জয় পেয়েছিলো বাংলাদেশ। যার ভিতর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথেও জয় ছিলো। এরপরই খেই হারিয়ে ফেলে টাইগাররা। নিজেদের ৪র্থ জয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় টানা ৪ বছর এবং ১৩ ম্যাচ। ২০১২ সালে সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই হারিয়ে জয়ে ফেরে বাংলাদেশ।

এরপর চলতি দশকে উত্থান পতনের ভিতর দিয়েই শেষ হয়েছে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ গুলো। দুর্দান্ত দাপট দেখিয়ে কিছু ম্যাচ জিতলেও ধারাবাহিকতা ছিলো না কখনোই। মাঝে আয়ারল্যান্ডকে হোয়াটওয়াশ, এশিয়াকে কাপের ফাইনাল খেলা এবং নিদাহাস ট্রফি হাইলাইটস হয়ে আছে বাংলাদেশের টি-টুয়েন্টি কাব্য গাথায়। আফগানিস্তানের সাথে হোয়াটওয়াশ ও বিশ্বকাপে কেনিয়ার কাছে পরাজয় কালো অধ্যায় হয়ে আছে টাইগারদের টি-টুয়েন্টি ইতিহাসে।

শেষ হয়ে গেলো আরো একটি বছর। হাটি হাটি পা পা করে বাংলাদেশও কাটিয়ে ফেললো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে ৩৫টি বছর। পরিসংখ্যান বলছে এই ৩৫ বছরে ব্যর্থতার অনুপাতে সফলতা খুবই কম। কিন্তু সেই ছোট ছোট সফলতাই একটা জাতিকে এক সাথে দাঁড় করিয়েছে। ভবিষ্যতেও দাঁড় করাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link