উইকেট-খেকো বাঘ!

তাঁকে ঠিক মিতব্যয়ী বোলারদের কাতারে ফেলা যায় না। বরং খরুচে বোলার হিসেবে তাঁর একটা দুর্নাম আছে। কিন্তু এই সময়ে এসে কোন পেসারই রান আটকানোয় পারদর্শী? রানপ্রসবা পিচের এ যুগে পেসারদের আসলে কিছু করারও তো থাকে না। কোনো না কোনোদিন ব্যাটারদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করতেই হবে। এটাই যেন পেসারদের নিয়তি। বাংলাদেশের পেসার এবাদত হোসেনও সেই নিয়তি মেনেই এগিয়ে চলেছেন।

তবে ব্যাটারদের প্রতাপের বিপরীতে পাল্টা আগ্রাসন দেখানোর জন্য তিনি যে সদা প্রস্তুত। রান দিচ্ছেন, বাউন্ডারি হজম করছেন। কিন্তু হঠাতই দুর্দান্ত এক ডেলিভারি দিয়ে দলকে ব্রেক থ্রু এনে দিচ্ছেন। এবাদত হোসেনের কাজটাই যেন এমন, উইকেট নেওয়ার দারুণ এক সক্ষমতা যেন তাঁর রন্ধ্রে।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচটাই ধরা যাক। প্রথম ওভারে বলে এসেই দিলেন ৮ রান। এবাদতের ঐ ওভার দিয়েই আইরিশরা বাংলাদেশি বোলারদের উপর চড়াও হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু পরের ওভারে এসেই এবাদত গতি দিয়ে পরাস্ত করলেন পল স্টার্লিংকে।

লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে বল করলেন। কিন্তু যেমন পেসে তিনি বল করলেন তাতে স্টার্লিং শট খেলতে উদ্যত হলেন। আর তাতেই মিলল ফল। গতির কারণে ব্যাটে বলে ভালভাবে সংযোগ ঘটলো না। যার কারণে উইকেটরক্ষক মুশফিকের গ্লাভসে গিয়ে ক্যাচ। উইকেটে থিতু হয়ে ওঠা স্টার্লিংয়ের বিদায়।

পরের ওভারেও একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এবার এবাদতের শিকার হলেন হ্যারি টেক্টর। এবাদতের এমন আকস্মিক আক্রমণে সেখান থেকেই আইরিশদের ইনিংসের ভাঙন শুরু হয়। এরপর আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি তারা। ইনিংসের শুরুর মতো আইরিশদের ইনিংসের শেষ আঘাতও আসে এবাদতের সৌজন্যে। সব মিলিয়ে দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৪ টি উইকেট নিয়েছেন এ ডান হাতি পেসার।

কিন্তু আইরিশদের ১৫৫ রানের ছোট সংগ্রহের পথে ব্যাটারদের কাছে সবচেয়ে পিটুনিটা খেয়েছেন আবার সেই এবাদতই। দলের মধ্যে একমাত্র এবাদতের ইকোনমি রেটই ৬ ছাড়িয়েছিল। কিন্তু সে সব তখনই গৌণ বিষয় হয়ে পড়ে যখন দেখা যায়, ঐ এবাদতের কারণেই আয়ারল্যান্ডের টপঅর্ডাররা উঠে দাঁড়াতেই পারেনি। একই সাথে আইরিশদের এমন অল্প রানে বেঁধে দেওয়ার নেপথ্যেও তো এই এবাদতই ছিলেন।

লাল বলের ক্রিকেট দিয়ে এবাদতের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পথচলা শুরু, এটা সবারই জানা। কিন্তু ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাঁর আরেক দুর্নাম ছিল, উইকেট খরা। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট দিয়ে তাও সে দুর্নাম কিছুটা ঘুচিয়েছিলেন। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ভয়াবহ বোলিং গড় এখনও কমেনি। পরিসংখ্যান বলেন, টেস্ট ক্রিকেটে প্রায় প্রতি ৫৭ টা বলে একটি উইকেট নিয়েছেন তিনি।

এমন ভয়ংকর পরিসংখ্যান নিয়ে যখন তাঁর সাদা বলের ক্রিকেটে অভিষেক হলো তখন স্বয়ং দেশের অনেক গণমাধ্যমেই সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার! লাল বলের ক্রিকেটের সেই এবাদত এখন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে খেলতে নামলেই যেন উইকেটের পসরা সাজিয়ে বসেন।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের জেতা সে ম্যাচে এবাদত একাই নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। এবার আইরিশদের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই নিলেন ৪ উইকেট। টানা দুই ম্যাচে ৪ উইকেট। সব মিলিয়ে ৬ ম্যাচের ছোট ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১৭ টা উইকেট! আর বোলিং গড়টা ১৭! অর্থাৎ প্রতি ১৭ বলে একটি করে উইকেট।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও ধরে রেখেছেন সেই একই চিত্র। বাংলাদেশের হয়ে খেলা ৪ ম্যাচে ৭ উইকেট। বোলিং গড় ২০! টেস্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা এবাদত যেন নিজের প্রিয় অঙ্গন বানিয়ে ফেলছেন এই সাদা বলের ক্রিকেটে।

কী অদ্ভুত বৈপরীত্য। টেস্ট ক্রিকেটে যেখানে একটি উইকেট পাওয়ার জন্য স্পেলের পর স্পেল বল করে যেতেন, সেখানে ফরম্যাটটা বদলে গেলেই ভিন্ন চেহারার মঞ্চায়ন হয়।

একটা তথ্য জানিয়ে রাখতেই হয়। পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ডের অধীনে বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে তাসকিনের সাথে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী পেসার কিন্তু এই এবাদত। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁর উইকেট সংখ্যা ৩৬ টি। কিন্তু তাসকিন এই ৩৬ টি উইকেট নিতে যেখানে ২৯ টি ম্যাচ খেলেছেন, সেখানে এবাদত খেলেছেন মাত্র ১৬ টি ম্যাচ।

এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, এবাদতের উইকেট শিকার করার দক্ষতা কতটা দুর্দান্ত। এবাদতের এখন প্রয়োজন শুধু এই ধারাবাহিকতাটা ধরে রাখা। এর পাশাপাশি, একই লেন্থে টানা বল করে যাওয়া নিয়েও তিনি আলাদা ভাবে কাজ করতে পারেন। এতে করে, রান আটকানোর কাজটাও তিনি ঠিকঠাকভাবে করতে পারবেন। আর এ দুইয়ের মিশেলে এবাদত হয়ে উঠবেন দুর্দান্ত এক পেসার। এবাদতের গতিময় এ যাত্রা চলতে থাকুক।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link