ছেলে বড় হয়ে ক্রিকেটার হবে — এমন স্বপ্নেই বুঁদ হয়ে ছিলেন পাকিস্তানের এক পুলিশ কর্মকর্তা। বাবার স্বপ্নের পথে ছেলেও হাঁটলেন। লাহোরের এক ক্লাবে ব্যাটার হিসেবে সুযোগও পেয়ে গেলেন। যেখানে একই সাথে বোলার হিসেবে সুযোগ মিলেছিল ওয়াসিম আকরামেরও।
কিন্তু ওয়াসিম আকরাম পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেরা পেসার হিসেবে বিশ্ব আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু বাবার স্বপ্নে এগিয়ে চলা ছেলেটির ক্যারিয়ার আটকে গেল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গোটা বিশেক ম্যাচ খেলেই। ছেলেটির নাম আলিম দার।
পুলিশের চাকরিটাই বড্ড অদ্ভুত। আজ এখানে, তো বছর না ঘুরতেই অন্যত্র পোস্টিং। আলিম দারের বাবাও সেই নিয়তির ভুক্তভোগী হলেন। যার কারণে কোনো জায়গাতেই স্থায়ী না হওয়ার মাশুল আলিম দারকে দিতে হলো ক্রিকেট ক্যারিয়ারে। ক্রিকেটার হিসেবে আর থিতু হতে পারলেন না আলিম দার। তবে এরপরে বাইশ গজ আঁকড়ে ধরে তিনি যা করেছেন, তাতে একসময় তাঁকে ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্নে স্বপ্নাতুর বাবার গর্বিত ছেলে ঠিকই হয়েছেন।
ক্রিকেটার হতে পারেননি, তবে আম্পায়ার হয়েছেন। মাথায় হ্যাট পরে বছরের পর বছর বাইশ গজে বিচরণ করেছেন তিনি। সিংহভাগ নির্ভুল সিদ্ধান্তে যিনি সময়ের ব্যবধানে হয়ে উঠেছিলেন আম্পায়ারদের পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত মুখ।
আম্পায়ার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলিম দারের শুরু ২০০০ সালে। এরপর ২০০২ সালে আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল প্যানেলে যুক্ত হন তিনি। এর দুই বছর পর তাঁকে আম্পায়ারদের এলিট প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর দীর্ঘ ১৯ বছর এই এলিট প্যানেলের সদস্য ছিলেন তিনি।
দীর্ঘ আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে ১৪৫ টি টেস্ট, ২২৫ টি ওয়ানডের পাশাপাশি ৬৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পরিচালনা করেছেন আলিম দার। এর মধ্যে ছিল ২০০৬ আইসিসি ট্রফি ফাইনাল, ২০০৭ ও ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল। এ ছাড়া ২০১০ ও ২০১২ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচে অনফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন আলিম।
আম্পায়ার হওয়ার পর আলিম দারের বাবা সব সময় চাইতেন, ‘ছেলে যেন সেরা আম্পায়ারের পুরস্কারটা পায়।’ বাবার সেই চাওয়া আলিম দার পূরণ করেন ২০০৯ সালে। সে বছর আইসিসি’র বর্ষসেরা আম্পায়ার নির্বাচিত হন পাকিস্তানি এ আম্পায়ার।
কিন্তু আলিম দার যখন পুরস্কার পেলেন তখন তাঁর বাবা আর পৃথিবীতে নেই। তাই এই পুরস্কার জয়ের পর আলিম দার বিমানবন্দর থেকে সোজা চলে গিয়েছিলেন বাবার কবরে। বাবার চাওয়া পূরণের আনন্দে সেদিন অঝরে কেঁদেছিলেন এই আম্পায়ার। আলিম দারের সেরা হওয়ার যাত্রা সেখানেই থেমে থাকেনি। ২০০৯ এর পর ২০১০ ও ২০১১ টানা তিন টানা তিন বছর আইসিসির বর্ষসেরা আম্পায়ারের স্বীকৃতি পান আলিম দার।
আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে অর্জনের আতিশায্যে আলিম দারের একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা আছে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে সেবার আম্পায়ারিংয়ের জন্য পাকিস্তান থেকে অনেকটা দূরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন আলিম দার। তো সে সময়েই ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনা। আলিম দারের মেয়ে জাভেরিয়া এপিলেপ্সি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
কিন্তু আলিম দারের কাছে সে খবর পৌছাল বেশ কিছুদিন পর। সে বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালের ম্যাচে আগে তিনি এই খবর জানতে পারেন। মূলত, বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে আলিম দার যেন না ভেঙে পড়েন সেই কারণেই তাঁকে জানানো হয়েছিল না। এমনটাই পরবর্তীতে জানিয়েছিলেন আলিম দারের সহধর্মিণী নোশাবা বানু। আলিম দারের পেশাদারিত্ব আর কাজের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত ছিল গোটা পরিবার। আর সে কারণেই কন্যার মৃত্যুর খবর বাবা পেয়েছিলেন অনেকটা পরে।
আলিম দার আম্পায়ার হিসেবে কতটা বিচক্ষণ তার প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি ২০১১ বিশ্বকাপে। সেবারের বিশ্বকাপেই প্রথম ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম চালু করেছিল আইসিসি। আর সেই বিশ্বকাপে একমাত্র নির্ভুল আম্পায়ার ছিলেন আলিম দার। সেবার আলিম দারের কাছে ১৫টি সিদ্ধান্তের রিভিউ চেয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। আর সেই ১৫ বারই আলিম দারের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল।
আলিম দারের সমৃদ্ধময় আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে বিতর্কও আছে। সেটি আবার দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলাদেশের সাথে মিশে আছে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন আলিম দার। আর সেই ম্যাচে রোহিত শর্মাকে করা রুবেল হোসেনের একটি বলকে ‘নো বল’ ঘোষণা করা নিয়ে সেবার তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। এমনকি সেটি মানববন্ধন পর্যন্তও গড়িয়েছিল। আলিম দারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ স্বরূপ ঢাকায় সেবার একটি মানববন্ধনের ডাক দেওয়া হয়েছিল।
তবে সেই একটি বড় ভুল বাদে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময়ে নির্ভুলই ছিলেন আলিম দার। গুটিকতক ভুলে বিপরীতে ১৯ বছরের ক্যারিয়ারে নিজের বিচক্ষণতাই বেশি দেখিয়েছেন এ আম্পায়ার।
২০১৫ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশি সমর্থকদের তোপের মুখে পড়লেও এই বাংলাদেশের সাথেই কিন্তু মিশে আছে আলিম দারের প্রথম ও শেষ স্মৃতি। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক হয়েছিল আলিম দারের। আর এর ২০ বছর বাদে, সেই বাংলাদেশের মাটিতেই বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড টেস্ট দিয়ে শেষ হলো আলিম দারের আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার।
মিরপুরের এ টেস্ট শেষে গার্ড অব অনারের সম্মাননা পেলেন আলিম দার। যদিও আম্পায়ার হিসেবে এখনও ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ আছে তাঁর। তবে আইসিসি এলিট প্যানেল মেম্বার হিসেবে এখানেই ইতি আলিম দারের। ভবিষ্যতে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) চাইলে পাকিস্তানের মাটিতে আম্পায়ারিং করতে পারেন আলিম দার। তবে তাঁর প্রথম ও শেষের স্মৃতিতে মিশে থাকা বাংলাদেশের মাটিতে আর দেখা মিলবে না আম্পায়ার আলিম দারকে।
মূলত, নিজের ইচ্ছাতেই আইসিসি’র এলিট প্যানেল থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন আলিম দার। হয়তো, দীর্ঘ এ যাত্রা এখানেই থামাতে চেয়েছেন তিনি। ক্রিকেটারদের মতো আম্পায়ারদেরও তো এক সময় থামতে হয়। আলিম দারও থামলেন। প্রস্থান হলো, বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের। যখন তিনি বিদায় বললেন, তখন তাঁর নাম ডেভিড শেফার্ড, সাইমন টোফেলদের পাশে, কিংবদন্তীদের কাতারে।