চন্দরপল ও তাঁর কালো স্টিকার

ব্যাটের সামনের দিক পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকায় দেখতে অদ্ভুত হলেও তিনি বেশিরভাগ বলই ব্যাটের মাঝখানে খেলতে পারতেন। ক্যারিয়ার শুরুতে স্বাভাবিক স্টান্স অনুসরণ করলেও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর পূর্বেই কোচের পরামর্শে স্টান্স বদলে ফেলেন তিনি। চন্দরপলের ব্যাপারে দর্শকদের আরেকটা আগ্রহের বিষয় ছিও তার চোখের নিচের কালো স্টিকার। সবাই অবাক হয়ে যেতেন তার চোখের নিচের স্টিকার দেখে।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো বটেই ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শিবনারায়ন চন্দরপল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ব্যাটসম্যান ক্যারিবীয়দের হয়ে ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসন করেছেন প্রায় দুই যুগ। ব্রায়ান লারার মোহনীয়তা, রামনারেশ সারওয়ানের স্নিগ্ধতা কিংবা গেইলের মতো বিধ্বংসী না হয়েও সবার আড়ালে থেকে রান করার কাজটা তিনি করর গেছেন একমনে।

গায়ানার এক জেলেপল্লী থেকে উঠে আসা চন্দরপল ছিলেন লারাপরবর্তী যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংয়ের একমাত্র ভরসা। দুই যুগের ক্যারিয়ারের ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন পুরো বিশ্বজুড়ে। ডার্বিশায়ার, ডারহাম, গায়ানা, গায়ানা আমাজন ওয়ারিহর্স, খুলনা রয়েল বেঙ্গলস, ল্যাংকারশায়ার, স্ট্যানফোর্ড সুপারস্টার, ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ব্যাট হাতে রানের ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন তিনি।

এমনকি টেস্ট স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি থাকলেও খেলেছেন আইপিএলে, রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে ম্যাচ জেতানো ইনিংসও আছে তারঁ। মাত্র সতের বছর বয়সে ১৯৯৩ সালে জর্জটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। সবমিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১৬৪ টেস্ট খেলে ৫১.৪৬ গড়ে ১১,৮৬৭ রান করেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের তালিকায় তিনি আছেন অষ্টম স্থানে।

অথচ ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তাকে ব্যাট করতে হয়ে ছয় কিংবা সাত নম্বরে। আরো উপরে ব্যাট করলে কে বলতে পারে হয়তো শচীন টেন্ডুলকার, রিকি পন্টিংয়দের কাতারেই ক্যারিয়ার শেষ করতেন। কেবল লাল বলেই নয় সাদা বলেএ সমান কার্যকরী এক ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ২৫১ ম্যাচে করেছেন ৮,৭৭৮ রান। চন্দরপলের বিপক্ষে প্রায়ই প্রতিপক্ষের অভিযোগ ছিল তিনি উইকেটে ধ্যান করতে বসেন।

রান করাতে তার নাকি আগ্রহই নেই, উইকেটে বসতবাড়ি গড়ে বসেন। অথচ দলের প্রয়োজনে হাতখুলে খেলতেও তার সমান দক্ষতা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একবার টেস্টে ৬৯ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। এছাড়া শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চামিন্দা ভাসের শেষ দুই বলে চার-ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে জয় এনে দেওয়ার ঘটনা তো এখনো মুখে মুখে ঘুরে ক্রিকেট রোমান্টিকদের। ক্রিকেট মাঠে তাকে আউট করা ছিল বোলারদের জন্য সবচেয়ে দুরহ কাজের একটি।

তাঁর ২৮০ ইনিংসের টেস্ট ক্যারিয়ারের মুখোমুখি হয়েছেন ২৭ হাজারের বেশি বলের। তবে বাকি সব ব্যাটসম্যানের চাইতে চন্দরপল ছিলেন আলাদা। ক্রিজে এসেই বেল দিয়ে উইকেটে ঠুক ঠুক করে মার্ক করে স্টান্স নিতেন তিনি। এরপর প্রথাগত ব্যাটসম্যানদের চেয়ে অনেকটা আলাদা স্টান্সে ব্যাট করতেন। আড়াআড়ি কাঁকড়ার মতো করে ব্যাটটাকে রাখতেন শরীরের সাথে ৯০ ডিগ্রী কোণ করে।

ব্যাটের সামনের দিক পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকায় দেখতে অদ্ভুত হলেও তিনি বেশিরভাগ বলই ব্যাটের মাঝখানে খেলতে পারতেন। ক্যারিয়ার শুরুতে স্বাভাবিক স্টান্স অনুসরণ করলেও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর পূর্বেই কোচের পরামর্শে স্টান্স বদলে ফেলেন তিনি। চন্দরপলের ব্যাপারে দর্শকদের আরেকটা আগ্রহের বিষয় ছিও তার চোখের নিচের কালো স্টিকার। সবাই অবাক হয়ে যেতেন তার চোখের নিচের স্টিকার দেখে।

পুরো ক্রিকেট বিশ্বেবতার সমসাময়িক ক্রিকেটারদের মাঝে খুব মানুষই জানতেন তার এই কালো স্টিকার পড়ার কারণ। আসলে ওই কালো স্টিকার দুটো ছিল অ্যান্টি-গ্লেয়ার স্টিকার। সূর্যের আলোর কারণে প্রায়শই বল দেখতে সমস্যা হয় ব্যাটসম্যানদের। মূলত স্টিকারগুলো চোখের আশেপাশে আলোর প্রভাব কমিয়ে দেয়। ফলে চন্দরপল বল দেখতে কিছুটা কম সমস্যার সম্মুখীন হতেন।

কেবল ব্যাটিং নয় ফিল্ডিংয়ের সময়ও সূর্যের আলোর হাত থেকে এভাবে রক্ষা পেতেন চন্দরপল। চন্দরপল ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হলো। তার ছেলে ত্যাগীনারাইন চন্দরপল দাপিয়ে বেড়ান ক্যারিবিয়ান স্টেডিয়ামগুলোতে। তবু ভক্তরা আজও মিস করে ধীর পায়ে হেঁটে এসে ঠুক ঠুক করে অদ্ভুত স্টান্স নেয়া কালো স্টিকারওয়ালা সেই মৌন ঋষিকে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...