২০০৬ সাল। চ্যাপেল-মোড়ে-দ্রাবিড়-শ্রীনিবাসন-শরদ পাওয়ার-আনন্দবাজার-দক্ষিণ ভারতের সাংবাদিক আর ক্রিকেটীয় লবি-পশ্চিম ভারত আর গো বলয়ের লবি। স্রেফ একটা ইনিংসের ব্যার্থতাই ক্যারিয়ার জন্মের মতো শেষ করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ঠ। দল নির্বাচনের আগে হোটেলে শুভান্যুধায়ী সাংবাদিকেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন ঘাড়ে যখন করাত লেগেই আছে তখন কামব্যাক করার জন্যে এত তাড়াহুড়ো করছো কেন?
তোমার স্বপক্ষে দেশ জুড়ে যে জনমতের হাওয়া বইছে তাতে বোর্ডকে অন্তত: একটা সুযোগ তোমাকে দিতেই হবে। সাউথ আফ্রিকা সফরের পরেই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেশের মাঠে খেলতে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে সবুজ উইকেটে স্টেইন, এনতিনি, মর্কেলদের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে দেশের মাঠের পাটা উইকেটে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে কামব্যাক করাটা সুবিধেজনক হত না?
এক সাংবাদিকের বয়ানে – কথাটা শোনামাত্রই হঠাৎ সৌরভ উঠে দাঁড়িয়ে যান। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ব্যাটটার তুলে নিয়ে আয়নার সামনে শ্যাডো করতে শুরু করেন। সংকল্প যেন চোখ মুখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিলো। তারপর চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বসে থাকা বন্ধু সাংবাদিকদের বলেন – এইভাবে পালিয়ে পালিয়ে ক্রিকেট হয় না। যেখানে সুযোগ আসবে সেখানেই প্রমাণ করতে হবে। আমি খেলবো।
দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছালেন। ভারত সম্ভবত সাত ওয়ানডে ম্যাচের সিরিজ ০-৭ হেরে বসে আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার দুধর্ষ পেস অ্যাটাকের সামনে খাবি খাচ্ছেন ভারতের তাবড় তাবড় অভিজ্ঞ এবং ইয়ং স্টারেরা। এতদিনের সঙ্গী সাথীরা কেউ ভয়ে তার সাথে কথাই ঠিকমতো বলছিলেন না, কে জানে কথা বললেই যদি বোর্ড আর চ্যাপেলের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়। জেট ল্যাগে ক্লান্ত সৌরভ যখন নেট করতে নামলেন তাকে নকিং করাতে এগিয়ে এলেন গ্রেগ চ্যাপেল।
বল ছোঁড়ার আগে শ্লেষ মিশিয়ে বললেন – ফাইনালি ইউ আর ব্যাক! কোনো জবাব দেননি। শুধু নকিং করে গেলেন। সামনে সিরীজের একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। সৌরভ গাঙ্গুলির মতো স্লো প্লেয়ারদের সেখানে জায়গা হওয়ার কথা নয়। একদিনের ম্যাচে আদৌ তাকে ফেরানো হবে কিনা সেটা নিয়েই ধোঁয়াশা। দলের টিম মিটিংয়ে স্কোয়াডের সদস্য হিসাবে থাকবার আর প্রাক্তন অধিনায়ক হিসাবে কয়েক মিনিট বলবার সুযোগ দয়া করে টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে দিয়েছিল।
রাহুল দ্রাবিড় আর গ্রেগ চ্যাপেলের অতীব ম্যাড়মেড়ে জোলো বক্তৃতা এবং শুধু প্লেয়ার ধরে ধরে সমালোচনা শেষ হওয়ার পরে ০-৭ হেরে দরকচা মেরে থাকা একটা টিমের সামনে প্রবল বিতর্কিত এবং অপাঙ্গক্তেয় সৌরভ সেদিন বলেছিলেন – হার জিৎ খেলার অংশ। যেটা হয়ে গেছে সেটা অতীত। অতীতে কি হয়ে গেছে সেটা ভুলে যাও। আমরা সামনে দেখবো। সামনের একটা একটা করে ম্যাচ ধরে ভাবো। দক্ষিন আফ্রিকার এই ক্রিকেট টিম কোনো মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি। ওরাও আমাদের মতো এই গ্রহের মানুষ। প্লেয়ার আমাদেরও আছে। আমাদের শুধু নিজেদের ওপরে বিশ্বাস রেখে উজ্জিবীত ক্রিকেট খেলতে হবে।
এই কয়েকটা লাইন পুরো টিমটাকে যেন ইলেক্ট্রিকের শক খাইয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলো।
বীরেন্দ্র শেবাগ সেইদিনের স্মৃতি চারণায় বলেছিলেন – ও যখন দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলছিলো আমি তখন অবাক হয়ে শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম আর একটা ম্যাচে ব্যার্থ হলে যে নিজেই টিমে থাকবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই সে এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই ধরনের বক্তব্য কি ভাবে রাখছে!
এরপর ভারত মাঠে নামে আর ০-৭ হেরে থাকা একটা দল কোনো একটা মানুষের জাদু কাঠির ছোঁয়ায় রাতারাতি দারুণ ক্রিকেট খেলে সিরীজের একমাত্র টি টোয়েন্টি ম্যাচে দক্ষিন আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয়।
প্রথম টেস্টের আগে প্রস্তুতি ম্যাচ পোচস্ট্রুমে। ব্যাট হাতে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার শেষ সুযোগ। মুখে তো অনেক বড় বড় কথা বলছে। মাঠে নেমে আসল কাজের কাজ কি করে দেখি! অনেকের মনেই তখন এই প্রশ্ন। মাঠে নেমে ৮৩ রানের একটা অসাধারন ইনিংস খেললেন সৌরভ গাঙ্গুলি। আবার জিতলো ভারত।
এরপরে আসল পরীক্ষা টেস্ট। সৌরভের সাথে মাইন্ডগেম খেলার চেষ্টা করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রকার ফাস্ট বোলার মাখায়া এনতিনি। বলেছিলেন – ‘সৌরভ ভুল জায়গা বেছে নিয়েছে। কিছুই করতে পারবে না। ওর গলদ সব আমি ধরে ফেলেছি।’
জোহানেসবার্গে দল যখন চরম সংকটে তখন প্রায় এক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থাকা সৌরভের ব্যাট থেকে বেরিয়ে এলো অপরাজিত ৫১ রানের একটা লড়াকু ইনিংস। নিজের ইনিংসের একমাত্র বিশাল ছক্কাটা মেরেছিলেন তার ‘সব গলদ ধরে ফেলা’ মাখায়া এনতিনিকেই। সেঞ্চুরী নয়, ডবল সেঞ্চুরী নয় মাত্র ৫১ টা রান। কিন্তু প্রতিহিংসামূলক সমালোচনায় ছিন্নভিন্ন এবং দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা মানুষের লড়াকু এই ৫১ টা রানই আবার ড্রেসিংরুমে স্পার্ক করলো। দক্ষিন আফ্রিকাকে প্রথমবারের মতো তাদেরই মাটিতে হারিয়ে প্রথম টেস্ট জিতে গেলো ভারত। ওয়ান্ডার্স টেস্ট ম্যাচ ঢুকে গেলো ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথায়।
না, এই সিরিজে পাঁচশো রান করেন নি। কোনো সেঞ্চুরী বা ডবল সেঞ্চুরীও ছিলো না। বর্তমান ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছে ভালো প্লেয়ারের যেটা অন্যতম মাপকাঠি সেই স্ট্রাইকরেটও মনে হয় একশোর নিচে ছিলো। বলার মধ্যে ছিলো শ দুয়েক রান যেটা সেই সিরীজে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং দুই দলের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর গোটা দুয়েক হাফ সেঞ্চুরী। রেকর্ড বুকে সেটাই লেখা থাকবে।
যেটা পরিসংখ্যানের পাতায় লেখা থাকবে না সেটা হলো চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থাকা একটা মানুষ নিজের ক্যারিয়ারের জীবন মরন সময়ের মধ্যে দক্ষিন আফ্রিকায় গিয়ে তাদের মারাত্মক বোলিংয়ের সামনে নাজেহাল হতে থাকা পরপর হারতে থাকা নিজের দেশকে আনঅফিশিয়ালি অধিনায়কত্ব করে আর নিজের পারফর্ম্যান্স দিয়ে আবার জয়ের রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছিল।
রেকর্ড বুকে শুধু পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ থাকে। মুহুর্ত আর সময়কাল লেখা থাকে না। সেইজন্যেই নেভিল কাডার্সের মতো জগৎ বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে পরিসংখ্যানকে ‘গাধা’ বলে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় সৌরভ গাঙ্গুলির গড় হল ৩৭, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এই গড় কতজন ভারতীয় প্লেয়ারের আছে আমার জানা নেই।
এরপরে দেশের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নীল জার্সী ফেরৎ পান। প্রায় দেড় বছর পরে একদিনের ক্রিকেট খেলতে নেমে ৯৮ রানের একটা ইনিংস খেলেন (স্ট্রাইক রেট জানিনা)।
শচীন টেন্ডুলকার যখন অবসর ঘোষণা করেন সেই সিরীজ দক্ষিন আফ্রিকায় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড দক্ষিণ আফ্রিকার মতো জায়গাতে শচীনকে তার জীবনের শেষ টেস্ট খেলানোর ঝুঁকি নিতে চায়নি। তাই শুধু শচীনের অবসরের সময়টাকে বর্নময় আর নিরাপদ করে রাখার জন্যে তারা তড়িঘড়ি করে দেশের মাঠে একটা ঝটিকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আয়োজন করে দেয়। সৌরভ গাঙ্গুলির জন্যে এইভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে মঞ্চ প্রস্তুত করে দেওয়ার কেউ ছিল না।
সৌরভ গাঙ্গুলি জানতেন যদি কোনোক্রমে একটা সুযোগ আসে তাহলে সেটা মরুভূমি হোক বা সাগরের তলা সেখানে গিয়েই তাকে নিজেকে আবার প্রমান করে আসতে হবে। অবসর নেওয়ার এত বছর পরেও সৌরভ গাঙ্গুলী এইসব কারনেই আজও প্রাসঙ্গিক থেকে গেছেন।
সৌরভের প্রত্যাবর্তনের সেইদিনগুলোতে পরপর সিনেমা ফ্লপের ধাক্কায় বেসমাল ছিলেন অনিল কাপুর। উনিও এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন – আমিও কামব্যাক করবো। সৌরভ গাঙ্গুলী রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়েছে। রভীনা ট্যান্ডন একটি স্কুলে বিশেষ অতিথি হয়ে আমন্ত্রিত হয়ে বাচ্চাদের বলেছিলেন – পরীক্ষাকে তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। স্কুল জীবনের পরেও তোমাদের পরীক্ষা দিয়ে যেতেই হবে। সৌরভ গাঙ্গুলীর জীবন থেকে শেখার চেষ্টা করো।
সুনীল শেঠি বলেছিলেন – সৌরভ গাঙ্গুলি নামটা শুনলেই রক্ত গরম হয়ে যায়। আমরা তো এই সময়কালটার, এই মুহুর্তগুলোর সাক্ষী। এগুলোই আমাদের সোনালি নস্টালজিয়া।