কপি-পেস্ট, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি সব মিলিয়েই বাফুফে

দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নয় ছয় নিয়ে গুঞ্জন ছিল আগে থেকেই। সম্প্রতি ফিফার তদন্তে সেই গোঁজামিলই অবশেষে বেরিয়ে এসেছে। ফিফার ৫১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের দুর্নীতির চিত্র। 

ক্রীড়াসামগ্রী ক্রয়, ফুটবলারদের পোশাক থেকে শুরু করে ঘাস কাটার মেশিন, বিমানের টিকিট কেনা, নারী দলের পেছনে খরচ এবং ক্লাবগুলোকে দেওয়া অনুদানে দুর্নীতির তথ্য-উপাত্তের বিষয়টি তুলে ধরেছে বিশ্ব ফুটবলের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। 

আর তাতে ফিফা ফান্ডের অপব্যবহার, ভুয়া কাগজপত্র জমা দেওয়া এবং একই প্রতিষ্ঠানের তিনটি ভিন্ন নাম ব্যবহার করে দরপত্র আহ্বানে জালিয়াতি করার দায়ে সব ধরনের ফুটবল থেকে দুই বছরের জন্য সোহাগকে নিষিদ্ধ করেছে ফিফা। 

মূলত কোনো দরপত্র আহবান করলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। এরপরই তা চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু এর কোনোটিই অনুসরণ করেননি সোহাগ। বরং একই প্রতিষ্ঠানকে তিনটি ভিন্ন কোম্পানি হিসেবে দেখিয়ে সে দরপত্রে জালিয়াতি করেছেন তিনি।

মজার ব্যাপার হলো, পুরো প্রক্রিয়াটাই তিনি সম্পন্ন করতেন অদ্ভুত গোপনীয়তায়। ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, নিজ কার্যালয়ে দরপত্র আহবানকারী ব্যক্তিকে নিয়ে গোপনে বৈঠক করতেন। 

অবাক করার মতো অপেশাদারিত্ব ফুটে উঠতো সে সব কাজেও৷  একই আবেদনপত্র কপি-পেস্ট করা হতো তাঁরই সামনে। আর সে কারণে কোনো একটি আবেদনপত্রে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সবকটাতেই ভুল হয়ে যেত।

প্রসঙ্গত, এ সব তদন্তই সম্পন্ন করেছে ফিফার অধিভুক্ত কন্ট্রোল রিস্ক গ্রুপ। ক্রীড়া পরিধেয় সামগ্রী কেনার জন্য ২০২০ সালের জুনে একটি দরপত্র আহ্বান করেছিল বাফুফে। এই কেনাকাটার দরপত্রে স্পোর্টস লিঙ্ক, স্পোর্টস কর্নারে রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। বিডিংয়ে মালামাল সরবরাহের কাজ পায় স্পোর্টস লিঙ্ক।

 ২০২০ সালের ৫ আগস্ট বাফুফে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সোহাগ প্রায় ৩২ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য সরবরাহের কার্যাদেশ দেন। কিন্তু ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কন্ট্রোল রিস্কের তদন্তে উঠে আসে, যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বিড করেছিল সবকটিই একে অপরের সম্পূরক। কোনোটিতেই প্রতিষ্ঠানের সিল নেই এবং তিনটি প্রতিষ্ঠানই একই রকম কাগজ জমা দিয়েছে। আর সে গুলোতে অনেক ভুল ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। 

এছাড়া ২০২১ সালের মার্চে ফিফার বিডিও এলএলপির নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও উঠে আসে সোহাগের জালিয়াতি। তিনটি দরপত্রের ডিজাইন একই রকম এবং রবিন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেটা ছিল ভুয়া।এসব দেখে ফিফার কমিটি নিশ্চিত হয়, দরপত্রের উৎস একই, তিনটি কোম্পানি আলাদা নয়।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দামে ৪০০টি ফুটবল কেনে বাফুফে। এখানে মারিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এইচ ইউ জামান ট্রেডিং ও ওফেলিয়াস ক্লোজেট দরপত্র জমা দিয়েছিল। টেন্ডার পায় ওফেলিয়াস। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, কন্ট্রোল রিস্কের প্রতিবেদনে উঠে আসা দরপত্র জেতা ওফেলিয়াসের ঠিকানার অস্তিত্ব নেই। 

একই রকম জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে বিমান টিকিটের ক্ষেত্রেও। জাতীয় দলের ওমান সফরের জন্য ২০১৯ সালে বিমানের টিকিটের জন্য দরপত্র আহবান করেছিল বাফুফে। দরপত্রে প্রস্তাব দেয় আল মারওয়া, পূরবী ইন্টারন্যাশনাল ও মাল্টিপ্লেক্স ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস।

নভেম্বরে ফ্লাইট টিকিট বাবদ আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনালকে প্রায় সোয়া ২১ লাখ টাকা দেয় বাফুফে। কিন্তু ফিফার তদন্তে উঠে আসে বাফুফের নয় ছয়। তিনটি দর প্রস্তাবই শুরু হয়েছে একই কথা দিয়ে। সবকটিতেই আগের দরপত্রের ডকুমেন্টের লেখা হুবহু নকল করা ছিল। 

বাফুফের দুর্নীতির এখানেই শেষ নয়। ২০২০ সালে ঘাস কাটার জন্য দুটি দরপত্রের প্রস্তাব আহবান করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। একটি বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার এবং অন্যটি শোভা এন্টারপ্রাইজ। কাজটা পায় বাংলাদেশ হার্ডওয়্যার। কিন্তু ফিফার তদন্তে উঠে এসেছে, দুটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র একই জায়গা থেকে করা হয়েছে। 

সোহাগের এ দুর্নীতি নিয়ে সবাই অবগত হলেও এতদিনে কেউ প্রকাশ্যে সরব ছিলেন না৷ কিন্তু ফিফার তদন্তের পর থলের সব বেড়াল বেরিয়ে আসে। সোহাগ তো ফেঁসেছেনই। সভাপতির ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন কাজী সালাউদ্দিনও। এখন দেখার পালা, সোহাগেট পর দুর্নীতির অভিযোগের তির এখন কোন দিকে যায়। 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link