২৬ ডিসেম্বর, ২০০৬। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার অ্যাশেজ সিরিজের চতুর্থ টেস্ট চলছে। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক রিকি পন্টিং বোলিংয়ে আনলেন শেন ওয়ার্নকে। একটি ‘ক্লাসিক ওয়ার্ন ডিসমিসাল’ এর মাধ্যমে আউট করলেন অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে।
মাঠে উপস্থিত প্রায় ৯০ হাজার দর্শক সাক্ষী হলো এক ঐতিহাসিক রেকর্ডের। ৯০ হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন রেকর্ডের মালিক শেন ওয়ার্নকে। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম কোন বোলারের ৭০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য তো একবারই হয়।
এখন ক্রিকেটে বোলারদের দাপট আগের মতো নেই। কিন্তু ৭০-৮০ এর দশকে বোলারদের বিশেষ করে পেস বোলারদের দাপট ছিল অনেক বেশি। এখনকার তুলনায় স্পিন বোলারদের দাপট কমই ছিল বলা যায়। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ১৯৯২ সালে ভারতের বিপক্ষে সিডনিতে টেস্ট অভিষেক হয় শেন ওয়ার্নের।
অভিষেক ম্যাচে ১৫০ রানের বিনিময়ে শুধু রবি শাস্ত্রীর উইকেটটি নিতে সক্ষম হন।তিনি পরের টেস্টে ৭৮ রান দিয়ে উইকেট শূন্য থাকার পর দল থেকে বাদ পড়েন। এরপর শ্রীলঙ্কা সফরের দলে সুযোগ পেলে কলম্বো টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০৭ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকার পর তার এক পর্যায়ে ক্যারিয়ার গড় হয় ৩৩৫!
পরের ইনিংসে ক্রিকেট প্রথমবারের মতো ওয়ার্নের জাদুকরি বোলিং দেখতে পায়৷ অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ১৮১ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার রান হয় সাত উইকেটে ১৫০। ওই অবস্থা থেকে ১১ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ওয়ার্ন নিজের দলের জয় নিশ্চিত করেন। তাঁর পারফরম্যান্সের পর লঙ্কান অধিনায়ক রানাতুঙ্গা বলেছিলেন, ‘আমরা ৩০০ বোলিং গড়ের এক বোলারের কাছে হেরে গেলাম।’ শ্রীলঙ্কা সফরের পরের ম্যাচে ভালো পারফর্ম না করায় আবার দল থেকে বাদ পড়েন তিনি।
- বক্সিং ডে কামব্যাক
ওয়ার্ন পুনরায় দলে সুযোগ পান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বক্সিং ডে টেস্টে ঘরের মাঠে। প্রথম ইনিংসে ৬৫ রানে ১ উইকেট নেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে বিশ্ব দেখলো ওয়ার্ন ম্যাজিক। ৫২ রানে ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা ওয়ার্ন।
- শতাব্দীর সেরা বল
১৯৯৩ সালের অ্যাশেজের প্রথম টেস্টে ইংলিশ স্পিনের ভেলকিতে অজিরা ২৮৯ রানে অলআউট হওয়ার পর ফুরফুরে মেজাজে ব্যাটিংয়ে নামেন ইংলিশ দুই ওপেনার মাইক আথারটন ও গ্রাহাম গুচ। ৭১ রানের ওপেনিং জুটির পর আথারটন আউট হলে ক্রিজে আসেন স্পিনের বিপক্ষে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিং।
অজি অধিনায়ক বল তুলে দিলেন আনকোরা ওয়ার্নের হাতে ৷ স্পিনের বিপক্ষে ঐ সময় অন্যান্য ব্যাটসম্যানদের তুলনায় ভালো মাইক গ্যাটিং এর জন্য আনকোরা ওয়ার্নকে খেলা খুব একটা চ্যালেঞ্জের কিছু না ছিল না। ওয়ার্ন অ্যাশেজ ক্যারিয়ারের প্রথম বলটি ছুঁড়লেন। বলটি পিচ করলো লেগ স্টাম্পের বাইরে।
এমন অবস্থায় বলটি না ঘুরলে লেগ স্টাম্পের বাইরে অথবা ঘুরলে ব্যাট অথবা প্যাডে আসাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বলটি মাইক গ্যাটিংকে হতভম্ব করে দিয়ে আঘাত করলো অফ স্টাম্পের বেলে। হতভম্ব অবস্থায়ই মাঠ ছাড়েন গ্যাটিং৷ ঐ বলটিকে পরবর্তীতে আখ্যায়িত করা হয় শতাব্দীর সেরা বল হিসেবে।
নিজের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে ৩৪টি উইকেট শিকার করে হয়েছিলেন সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার। ঐ বছরে ১৬ ম্যাচে ৭২ টি উইকেট শিকার করে কোন একটি ক্যালেন্ডার ইয়ারে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের তৎকালীন রেকর্ড নিজের করে নেন। ঐ বছর দিয়েই শুরু হয় ওয়ার্নের রূপকথার পথচলা।
১৯৯৪-৯৫ অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টে ওয়ার্ন ক্যারিয়ারের একমাত্র হ্যাট্রিক করেন। পরের টেস্টে তিনি আরেকজন টেল এন্ডার ব্যাটসম্যান টিম মেকে নিয়ে পঞ্চম দিনের খেলার শেষ ১৯ ওভার টিকে থেকে ড্র নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন। আগের দুই ম্যাচ জিতে যাওয়ায় ওই ম্যাচে নিশ্চিত হয় যে অ্যাশেজ ট্রফিটি অস্ট্রেলিয়ার কাছেই থাকছে।
- ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চের তারকা
ওয়ার্নের প্রথম বিশেকাপ ছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপ। ওই বিশ্বকাপে তিনি ১২ উইকেট সংগ্রহ করেন,যার মধ্যে সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চার উইকেটও ছিল। ফাইনালের আগে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন মার্ক টেইলর বলেছিলেন ওয়ার্নের একার পক্ষে বিশ্বকাপ জেতানো সম্ভব নয়। ফাইনালে ৫৮ রান দিয়ে উইকেট শূন্য থাকেন তিনি আর শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয়।
এরপরের বিশ্বকাপ ছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্বে ১২ উইকেট নেওয়ার পর সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে সেমিফাইনালে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার চার জন সেরা ব্যাটসম্যান – হার্শেল গিবস, গ্যারি কারস্টেন, হানসি ক্রনিয়ে ও জ্যাক ক্যালিসকে আউট করে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন ওয়ার্ন। ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৩ রানে ৪ উইকেট নিতে পাকিস্তানকে ১৩২ রানে আটকে রাখতে মূল ভূমিকা পালন করেন। ওই বিশ্বকাপে তিনি সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হয়েছিলেন।
ওয়ার্নের ইচ্ছা ছিল ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলে ওয়ানডে থেকে অবসর নেওয়া। কিন্তু ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে বিশ্বকাপ শুরুর এক দিন আগে তিনি এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন। এক বছর নিষিদ্ধ থাকার পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিরেই প্রথম দুই টেস্টের চার ইনিংসেই পাঁচটি করে এবং তৃতীয় টেস্টে ৬ উইকেট নেন ওয়ার্ন। ওই সিরিজে পান সিরিজ সেরার পুরস্কার।
২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ইরফান পাঠানকে আউট করে তিনি মুত্তিয়া মুরালিধরন এর ওই সময়ে ৫৩৩ উইকেটের রেকর্ড ভেঙে নিজের করে নেন এবং অবসর নেওয়া পর্যন্ত তিনিই ছিলেন টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক। ২০০৪ সালে আইসিসির বেস্ট টেস্ট একাদশেও জায়গা করে নেন তিনি।
২০০৫ সাল। ওয়ার্নের পারফরম্যান্স এর দিক দিয়ে একে ‘সেরা বছর’ বলা যায়৷ ওই বছর তিনি ৯৬ উইকেট নিয়ে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড করেন, যেটা এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। ২০০৫ সালে অ্যাশেজ সিরিজে ১৯.৯২ গড়ে ৪০ উইকেট নিয়ে ও ব্যাট হাতে ২৪৯ রান করে অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফের সাথে ম্যান অব দা সিরিজ হন ওয়ার্নও।
২০০৬-০৭ অ্যাশেজ ছিল ওয়ার্নের ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ। ১৫ বছর আগে যে সিডনিতে তাঁর অভিষেক হয়েছিল, ওই সিডনিতেই শেষ টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন ওয়ার্ন। ওই শেষ ম্যাচে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০০ উইকেটের মাইল ফলক স্পর্শ করেন, যে রেকর্ড আছে শুধু মুত্তিয়া মুরালিধরনের।
ক্যারিয়ারের শেষ দিকে সাধারণত ক্রিকেটারদের ফর্ম খুব একটা ভালো থাকে না। কিন্তু ওয়ার্ন এই দিক দিয়েও ছিলেন অনন্য। ২০০৪-২০০৬ টানা তিন বছর তিনি আইসিসির বেস্ট টেস্ট ইলেভেনে জায়গা করে নেন। ২০০০ সালে উইজডেনের ক্রিকেটার অব দা সেঞ্চুরির পাঁচ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ডন ব্র্যাডম্যান, গ্যারি সোবার্স, জ্যাক হবস, ভিভ রিচার্ডসের সাথে ওয়ার্নও ছিলেন।
শেন ওয়ার্নের যখন অভিষেক হয় তখন পেস বোলারদের স্বর্ণযুগ ছিল। শেন ওয়ার্নের পরেও মুরালিধরন, হরভজনদের মতো স্পিনাররা এসেছে। কিন্তু ওয়ার্নই ছিলেন ক্রিকেটে স্পিনারদের সোনালি সময়ের পথিকৃৎ। আর অন্যান্য স্পিনারদের থেকে ওয়ার্ন এগিয়ে থাকবেন অন্য কারণে। ইতিহাসের বেশিরভাগ স্পিনাররাই ছিলেন উপমহাদেশের, এর একটা কারণ ছিল উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক উইকেট।
কিন্তু, ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ম্যাচই পেস সহায়ক উইকেটে খেলে ৭০৮ উইকেট নিয়ে ওয়ার্ন অন্য স্পিনারদের তুলনায় এগিয়ে থাকবেন। শুধু স্পিনারই না, বিশ্বের সর্বকালের সেরা একাদশেও ওয়ার্ন জায়গা করে নিবেন সহজেই। তাই মুরালিধরন বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার হলেও সেরা স্পিনার হিসেবে অনেকে সংগত কারণেই ওয়ার্নকে মুরালি থেকে এগিয়ে রাখেন। তবে, ওয়ার্ন সেরা না মুরালি – এই বিতর্কের অবসান আজও হয়নি।