সাদা পোশাকে প্রথম জয়ের রোমন্থন

২০০৫ সালের ছয় জানুয়ারি। শীতের সকাল। সমুদ্রকন্যা চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামের পিচে সূর্য যতক্ষণে গ্যালারী আর দালান কোঠা ভেদ করে প্রবেশ করছে, ততক্ষণে ঘড়িতে সময় প্রায় পৌনে আটটা। ঘাসের আগায় থাকা কুয়াশার ফোটায় সূর্যের আলো পড়ে যেন মুক্তো হয়ে যাচ্ছে।

চারপাশ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে আর প্রাণবন্ত ঘাসের কুয়াশা শুকাতে শুরু করেছে। বাকি পাঁচটা দিনের মত ওই দিনটাতেও কোন ব্যতিক্রম ছিল না। রাস্তায় গাড়ির হর্ন, বন্দরে জাহাজের হুংকার, টিফিন বক্স হাতে চাকুরিজীবী আর ঘাম মুছতে থাকা রিকশাওয়ালা। কেউই আঁচ পারেনি নতুন এক ইতিহাসের শুরু হতে যাচ্ছে সেই সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে।

টেস্ট ক্রিকেটের ১৭৩৩ নম্বর ম্যাচ। বাংলাদেশের জন্য ৩৫ তম।

জিম্বাবুয়ের টাটেন্ডা টাইবু আর বাংলাদেশের হাবিবুল বাশারকে নিয়ে মাঠে যান ম্যাচ রেফারি রোশান মহানাম, আম্পায়ার আসাদ রউফ আর টাইরন বিজয়বর্ধনে। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হাবিবুল বাশার।

ওপেনিংয়ে জাবেদ ওমর বেলিমের সাথে সঙ্গ দেন নাফিজ ইকবাল। খুবই ধীর গতিতে রিয়েল টেস্ট মেজাজে খেলতে থাকেন দুজন। ১১০ বলে ৩৩ রানের ইনিংস খেলে জাভেদ ওমর বেলিম যখন প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটছেন তখন দলীয় রান ৯১। নাফিস ইকবালও তুলে নিয়েছেন হাফ সেঞ্চুরি। জাভেদ ওমর আউট হওয়ার পর বেশীক্ষণ টিকতে পারেননি নাফিস ইকবাল ও। স্কোরকার্ডে দুইরান যোগ হতেই নাফিসের ১২২ বলে ৫৬ রানের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে। তারপর আশরাফুলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার।

৬০ রানের জুটি ভেঙ্গে দেন লুলেকি এনকালা। আশরাফুলকে ফেরান মাসাকাদজার তালুর সহায়তায়। তারপর পিচে আসেন রাজিন সালেহ। দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়া ক্যাপ্টেন হাবিবুল বাশার রাজিন সালেহকে নিয়ে মাঠে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেন। আট বাউন্ডারিতে মাত্র ৫৬ বলেই হাফ সেঞ্চুরি করেন দলনেতা।

অন্যপ্রান্তে পাঁচ বাউন্ডারি আর এক ওভার বাউন্ডারিতে রাজিন সালেহ যখন নিজের হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন দলীয় রান তখন ২৫০+ আর নিজের সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন হাবিবুল বাশার। কিন্তু হয়ে ওঠেনি সেই শতক। ৯৪ রানে এমপফুর বলে তাইবুর হাতে নিজের উইকেট বিসর্জন দেন বাশার। ভাঙে ১১৯ রানের জুটি। তারপর আফতাব আহমেদ এসে ছয় রান যোগ করলে শেষ হয় প্রথম দিন।

পরের দিন সকাল বেলা রাজিন ৬০ রান আর আফতাব ৬ রানে অপরাজিত থেকে মাঠে নামেন। কোন রান যোগ না করেই আফতাব তল্পিতল্পা গুটিয়ে নেন প্যাভিলিয়ন যাত্রায়। দলীয় স্কোন তখন ২৮৩/৫। তারপর উইকেট রক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট এসে ভালোই সঙ্গ দিতে থাকেন রাজিন সালেহকে। ৫৮ রানের জুটি গড়ে তোলার পরেই আউট হয়ে যান সালেহ। ৮৯ রানে ম্যাটসেকেনয়ারির বলে তারই হাতে ক্যাচ না তুললে হয়ত রাজিন সালেহের ও একটা টেস্ট সেঞ্চুরি থাকতে পারত।

তারপর মোহাম্মদ রফিক এসে পাইলটের সাথে তাল দেন রান তোলায়। ৪৯ করে যখন পাইলট আউট হয়, তখন দলীয় স্কোর ৪১০। তারপর টেল এন্ডার মাশরাফির সাথে ৬৪ বলে ৬২ রানের পার্টনারশিপ গড়েন অভিজ্ঞ রফিক। তিন বাউন্ডারি আর চার ওভার বাউন্ডারিতে ব্যক্তিগত ৬৯-এ রফিক ফিরে গেলে দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪৭২/৮।

মাশরাফি তখনো উইকেটে। সবার মনে তখন ৫০০ হবে হবে না দ্বন্ধ । তাপস বৈশ্য আসলেন, আর ফিরে গেলেন। মাঝখানে দলের বাড়লো ৮ রান যার ৬ রান গেল তাপসের নামে। এনামুল হক জুনিয়র এলেন শেষ সিপাহি হয়ে। সাত বল খেলে রানের খাতা খুলতে পারেনি। তার আগেই ক্রেমারের বলে সিবান্দার হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে মাশরাফি ফিরলেন খাতা বন্ধ করে। ৪৮৮ রানের প্রথম ইনিংসটা বেশ ভালোই বলা চলে। এই সংগ্রহ দিয়েই ভালো লড়াই অন্তত করা যায়।

জিম্বাবুয়ের পক্ষে অভিষিক্ত এমপফু ৪ টি আর এনকালা এবং আরেক অভিষিক্ত ক্রেমার ২টি করে উইকেট পান।

জিম্বাবুয়ের হয়ে উদ্বোধন করেন অভিজ্ঞ মাতসিকেনেরি আর নতুন মুখ বার্নি রজার্স। দলীয় ৩১ রানের মাথায় তাপস বৈশ্যের বলে ক্যাচ তুলে দেন মাতসিকেনেরি। অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সেটা লুফে নেন দারুণ দক্ষতার সাথে। তারপর ভুসি সিবান্দা এসে ১২ রান যোগ করেই ফেরেন রফিকের এলবিডব্লুর ফাঁদে পড়ে।

আরেক ওপেনার রজার্স এবার রান আউটের শিকার হয়ে ফিরে যান ৪৭ বলে ৫ রান করে। ৪৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে যে চাপে জিম্বাবুয়ে পড়েছিল, তাতে আরেকটা পাথর যোগ করেন মোহাম্মদ রফিক। আবারে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেন ক্রেমারকে। মাসাকাদজা আর টেলর যখন মাঠে, জিম্বাবুয়ের স্কোর তখনো ৪৯/৪। দলের দুই সেরা ব্যাটসম্যান নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেন ম্যাচের। ২৮ রানে মাসাকাদজা আর ৮ রানে টেলর অপরাজিত থেকে শেষ করেন দ্বিতীয় দিনের খেলা।

তৃতীয় দিনের শুরুটা হয় আবারো স্বাগতিকদের হয়ে। দলীয় ৮৬ রানেই ভাঙে মাসাকাদজা আর টেলরের ২৭ রানের জুটি। কাপ্তান তাইবু তখন নিজেই দায়িত্ব বুঝে নেন দলের। ব্যক্তিগত ৩৯ রানে টেলর আউট হলেও খেলে গিয়েছিলেন ১৩১ টি বল। ৬৬ রানের জুটি যখন ভাঙে দলীয় স্কোর তখন ১৫২/৬। তারপর চিগুম্বুরা আসেন ক্রিজে। তাইবুর সাথে গড়েন ১১৯ রানের দলের জন্য স্বস্তির এক জুটি।

ব্যক্তিগত ৭১ রান করে ফেরেন চিগুম্বুরা আর মাঠে আসেন এনকালা। স্কোরকার্ডে আরো ৩৭ রান যোগ হলে ক্যাপ্টেনও পথ ধরেন প্যাভিলিয়নের। যাওয়ার আগে খেলেন ২৪১ বলে ৯২ রানের এক বিশাল ইনিংস। তারপর ডগলাস হুন্ডো আর এমপফু মাঠে নামলেও সময় নষ্ট করা ছাড়া স্কোরে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। এনকালা আর হন্ডো তৃতীয় দিন শেষ করে গেলে চতুর্থ দিনে দলের ভাণ্ডারে যোগ হয় চার রান। ৩১২ রানে শেষ হয় জিম্বাবুয়ের প্রথম ইনিংস। বাংলাদেশের হয়ে রফিক পাঁচটি আর মাশরাফি তিন উইকেট নেন।

মূলত জিম্বাবুয়ের ম্যাচে ফেরার চেষ্টা বলতে তখন ড্র করাই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। তাই তারা রানের তুলনায় বলে মনোযোগ দিতে থাকে অনেক বেশি। তাইবু আর চিগুম্বুরা মিলে খেলেন ৪০৫ বল! একটা পুরো দিনের সিংহভাগ নষ্ট করেন তাঁরা দুজন মিলে। তাদের এই পরিকল্পনা কাজেও দিয়েছে বলা যায়।

কারণ, প্রথম বাংলাদেশের ভালো ব্যাটিংয়ের পরেও তাদের ম্যাচে ফেরার সুযোগ তৈরী হয়। ইভেন, চতুর্থ দিন শেষেও অধিনায়ক সুমন বলেছিলেন, ‘জেতাটা এখনো সহজ নয়। জেতার জন্য শেষ দিনেও ভালোই কষ্ট করতে হবে।’

দুই ইনিংস শেষে বাংলাদেশ ১৭৬ রানে এগিয়ে থেকে তৃতীয় ইনিংসে মাঠে নামেন। তৃতীয় ইনিংসে জাবেদ ওমরের পরিবর্তে ওপনিংয়ে আসেন রাজিন সালেহ আর সাথে নাফিস ইকবাল। তৃতীয় ইনিংসের শুরুটা ভালো হয়নি টাইগারদের। নিজের রানের খাতা না খুলেই দলীয় ৭ রানে ফেরেন নাফিস।

তারপর বাশারের সাথে ৪০ রানের জুটি গড়ে রাজিন ফেরেন নিজের ২৬ রানে। তারপর ২২ রান করে আশরাফুল ফিরে গেলে আফতাব এসে ফিরে যান ১১ রান করে। ‘মিস্টার ফিফটি’ খ্যাত অধিনায়ক আবার হাফ সেঞ্চুরি করে নিজেও হাঁটেন প্যাভিলিয়ন মুখি হয়ে। সুমন যখন আউট হয়, স্কোর তখন ১৪৫/৫। তারপর পাইলট ২৩, জাবেদ ১৫, মাশরাফি ১৯, তাপস ১ রান করে একে একে ফিরে যান। রফিক ১৪ রানে অপরাজিত থেকে দলীয় ২০৪ রানে ইনিংস ঘোষণা করেন।

জিম্বাবুয়ের জয়ের জন্য টার্গেট দাঁড়ায় ৩৮১।

৩৮১ রানের লক্ষে ব্যাট করতে নেমে দুইরানেই জিম্বাবুয়ে হারায় তাদের প্রথম উইকেট। তাপসের বলে ক্যাচ নেন বদলি ফিল্ডার মানজারুল ইসলাম রানা। শূন্য রানে রজার্স ফেরার পর ভুসি সিবান্দাও ফিরে যান রানের খাতা না খুলেই। মাতসিকেনেরির সাথে মাসাকাদজা ক্রিজে থিতু হওয়ার আগেই আঘাত হানেন ইনামুল জুনিয়র। ব্যক্তিগত ২০ রানে মাতসিকেনেরির আউট আউট হলে ব্রেন্ডন টেলর আসেন।

তারপর আবারো আঘাত হানেন এনামুল জুনিয়র। ৮০ রানের জুটি ভাঙ্গেন টেলরকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলে। তারপর আপতাবের হাতে ক্যাচ তুলে বিনা রানে তাইবু আর বোলার এনামুলের হাতে ক্যাচ দিয়েই ফিরে যান দলীয় সর্বোচ্চ ৫৬ রান করা মাসাকাদজা। ১২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে জিম্বাবুয়ের হার তখন অনেকটা নিশ্চিত। শেষের দিকে চিগুম্বুরা ১০, এনকালা ৫, ক্রেমার ২ আর এমপফু ৫ রানে আউট হলে ১৫৪ রানে অলআউট হয় জিম্বাবুয়ে। হন্ডো অপরাজিত থাকেন ৫ রানে। বাংলাদেশের পক্ষে এনামুল হক জুনিয়র পান ৬ উইকেট।

বাংলাদেশের নিশ্চিত করে তাদের স্বপ্নের জয় আর এনামুল হক জুনিয়র পান ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার।

ততক্ষণে জয়ের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে পুরো দেশে। টেস্টের নাম শুনে চুপসে যাওয়া ক্রিকেটপ্রেমীর অন্তর সেদিন থেকে বুঝতে শিখেছে টেস্টের মজা কোথায়। আনন্দে গলা ফাটিয়েছে দর্শকেরা গ্যালারি কিংবা সড়কে। জয়ের নতুন দরজা খুলেছে বাশাির অ্যান্ড কোং। সময়টা একটু বেশিই নিয়েছে হয়ত। তবু কম কীসে?

পাঁচ বসন্তের আগে আগে ঘরে তুলেছে জয়। নাইমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাসুদ পাইলট আর খালেদ মাহমুদ সুজনদের পরে মশাল হাতে এগিয়ে আসা বাশারের হাত ধরেই বাংলাদেশ পেল প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ। সাথে প্রথম সিরিজ জয়ও হলো সেই টেস্টের কল্যানেই।

এরপর কালের ধারায় সময় এগিয়েছে। এগিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটও। শততম টেস্ট খেলে ফেলেছে দলটি। সাদা পোশাকে ক্রিকেটের মানও বেড়েছে। হয়ত হাজারতম টেস্টও খেলবে একদিন। প্রথম জয়ের মত শততম জয়ও ধরা দিবে একদিন হাতের মুঠোয়। কিন্তু যেই তৃপ্তি সেদিন বাশার, এনামুল, রফিকরা দিয়েছেন বাঙালিদের সেটার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। ক্রিকেট এগিয়ে যাবে নিজস্ব গতিতে। পরিক্রমায় উত্থান-পতন ঘটবে শতবার। একশো বার হেরে একশো একবার ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ এই আশাতেই টিভির সামনে বসে থাকেন দর্শকরা।

সেখানে ৩৫ টা টেস্ট বেশি কঠিন অপেক্ষা নয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link