স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল, স্যার ক্লাইভ ওয়ালকট এবং স্যার এভারটন উইকস। উইন্ডিজ ইতিহাসের সেরা তিনজন খেলোয়াড়। একজন সেরা ব্যাটসম্যান, একজন সেরা উইকেটকিপার আর আরেকজন সেরা অলরাউন্ডার। উইন্ডিজের তখনকার মিডল অর্ডার ব্যাটিং ছিলো খুবই দূর্বল কিন্তু এই ত্রয়ী আসার পর সেই মিডল অর্ডার হয়ে উঠে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং লাইন আপ।
এই তিন জনের ব্যাটিংয়ের সামনে মাথা নত করতে হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ার নেইল হার্ভে, লিন্ডসে হ্যাসেট বা ইংলিশ ডেনিস কম্পটন, পিটার মে এর বোলার দের। নামের আদ্যক্ষরের মিলের কারণে এই ত্রয়ীকে থ্রি ডব্লুজ নামে ডাকা হলেও তাদের মাঝে বেশ কিছু মিল রয়েছে। যেমন – এরা তিনজনই জন্মেছেন বারবাডোজের ব্রিজটাউনে মাত্র ১৭ মাসে ব্যবধানে, তিনজনেরই নিবাস ছিলো কেনিংসটন ওভাল থেকে ১ মাইলে মধ্য, তিনজনই মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান, তিনজনই পরবর্তীতে `নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত হন।
হ্যাডলি-দ্য ব্ল্যাক ব্রাডম্যান ছিলেন এভারটনের হিরো। ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজ। আর সেই সিরিজটি ছিলো যুদ্ধ পরবর্তী উইন্ডিজের কোনো প্রথম সিরিজ। সেই সিরিজে প্রথম ৫ ইনিংসে তিনি সর্বোচ্চ ৩৬ রান করেন। যা চতুর্থ টেস্টে তার দলে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। হ্যাডলির চোটের কারণে হ্যাডলির জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন তিনি।
বার্বাডোজ থেকে জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনে যাবার জন্য বিমানে উঠেন। কিন্তু বিমানের গোলযোগের কারণে বিরতি নিতে হয় পুর্তো রিকোতে। পরদিন যখন স্যাবাইনা পার্কে পৌঁছালেন তখন উইন্ডিজ ফিল্ডিংয়ে এবং লাঞ্চ হয়ে গিয়েছে। সে সময় এমন এক সিস্টেম ছিলো যে আপনি যদি দলে থাকেন তাহলে খেলার যেকোনো সময় খেলায় অংশ নিতে পারবেন।
এভারটন মাঠে নামার পর, স্যাবাইনা পার্কের দর্শকরা দুয়ো দিতে লাগলেন। কারণ এভারটনের পরিবর্তে ফিল্ডিংয়ে নেমেছিলো কিংস্টনের ঘরের ছেলে জন হল্ট। আর এই দুয়ো এর জবাব তিনি বেশ ভালো করেই দিয়েছেন। প্রথম ইনিংসে করলেন ১৪১ রান, আর উইন্ডিজ জিতলো দশ উইকেটে। দ্বিতীয় ইনিংসেই কাউকে ব্যাট ধরতে হয় নি। এইবার দর্শকরা মাঠে ছুটে আসলো তাকে তুকে ধরার জন্য।
পাওয়ারফুল স্কয়ার কাট, ব্যাকফুট পাঞ্চ আর ওয়েল কন্ট্রোলড মিড উইকেট পুল – এভারটনের ট্রেডমার্ক শট। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল স্কয়ার কাট। হাই ব্যাকলিফটের সাথে মাসল পাওয়ার ও চমৎকার ব্যাট স্পিড মিলে কাভার ও ভি অঞ্চল দিয়ে অনায়াসেই সীমানা পার করতেন তিনি। যেকোনো শট খেলার আগে তিনি খুব দ্রুত পজিশন চেঞ্জ করতে পারতো আর সেই জন্য এক্সট্রা স্ট্রোকের অপশন থাকতো। আর তার এই ব্যাটিং স্টাইল নিয়ে বিখ্যাত সাময়িকী ‘দ্য টাইমস’ লিখেছিলো, ‘lightly bow legged, with a wonderful eye, wrists the envy of any batsman and feet always in the right place to play a shot.’
ব্যাটিংয়ের সাথে সাথে তিনি ফিল্ডিংয়েও ছিলেন অনন্য।১৯৫০ সালের ইংল্যান্ড সফরের পর থেকে তিনি স্পেশালিষ্ট স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করলেও তিনি মূলত ছিলেন কাভার পয়েন্ট পজিশনে। তার ফিল্ডিং নিয়ে বিখ্যাত লেখক এফ.এল.বেলসন বলেছিলেন, ‘Weekes possessed the virtues of exceptional quickness of foot and anticipation, natural bent, plus very safe hands’
‘Technique flawless and the driving immaculate – both off front foot and back’, বলেছিল উইজডেন।
এভারটন ১৯৪৮ সালে প্রথম বার এসেছিলেন উপমহাদেশে খেলতে। সাত মাস পর উইলো হাতে মাঠে নামেন তিনি ভারতে বিপক্ষে। দিল্লিতে প্রথম টেস্টেই হাঁকান ১২৮ রানের শতক এবং জানান দেন বিরতিতে তো আমি ছিলাম আমার ব্যাটি না। এরপর মিশন বোম্বের ফ্ল্যাট ট্র্যাক এবং আরেকটা সেঞ্চুরি তবে করতে পারতেন ডাবল সেঞ্চুরি কিন্তু থামতে হলো ৬ রান দূরে।
এবার মিশন কলকাতার ইডেন গার্ডেন। সবুজ ঘাসের পিচ, যেন বোলারদের স্বর্গ। বোলারদের গতির ঝড়ে দুই ওপেনার ফিরলেন প্যাভিলিয়নে, কিন্তু এভারটন সাহেব সেই পেসারদের চোখ রাঙানি দিয়ে খেলেন ১৬২ রানের মাস্টারক্লাস ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংস আবার সেঞ্চুরি, পেসারদের রাজ্যে রাজ করলেন এক উইন্ডিজ। টানা পাঁচ ইনিংসে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড করলেন তিনি।
- Weekes finally fails – out for 90
মাদ্রাজে চতুর্থ টেস্ট। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১০ রান দূরে থাকতে বিতর্কিত রান আউটের শিকার হন তিনি। টানা ৬ ইনিংসে সেঞ্চুরির রেকর্ড আর করা হলো না তার। তারপরের ইনিংসে আবার অর্ধশতক করে টানা ৭ ইনিংসে হাফসেঞ্চুরি রেকর্ড করেন তিনি।
সেবার ভারত সফরে ৭ ইনিংস ব্যাটিং করে ৭৭৯ রান, আর গড় ১১১.২৯! আর এই পারফরম্যান্স এর ফলে ১৯৪৯ সালে ভারত ক্রিকেট বোর্ড তাকে বর্ষসেরা ক্রিকেটারের উপাধি দেয়।
ব্র্যাডমানের পর আর কোনো ব্যাটসম্যান নিজের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে এমন বড় স্কোরের সংগ্রাহক হিসেবে নিজের নাম লেখাতে পারেনি- উইজডেন। এবার মিশন ইংল্যান্ড। ওল্ড ট্রাফোর্ডে উইন্ডিজ হারলো বড় ব্যবধানে। আর এপর পুরাই গল্পের বিপরীত। লর্ডস, ন্যাটিংহ্যামশায়ার, ওভাল – ইংল্যান্ড বধ করলো উইকসরা।
আর সেই থ্রি ডব্লিউজ ছিলেন রীতিমতো দুর্ধর্ষ। ওরেল করলেন দুই সেঞ্চুরি আর উইকস ও ওয়ালকট একটি করে। ট্রেন্টব্রিজে প্রথম ইনিংসে ওরেল করেন ২৬১ আর উইকস ১২৯। সেই ইংলিশ পুরো সফরে তিনি করেছেন ২৩১০ রান, হেডিংলির চেয়ে ১০ রান কম। তবে মজার বিষয় তিনি খেলেছিলেন পাঁচ ইনিংসের কম।
- দ্যা ব্র্যান্ড অব থ্রি ডব্লিউজ
ওরেল, উইকস, ওয়ালকট; উইন্ডিজ ইতিহাসের ধ্বংসাত্মক মিডল অর্ডার। সে সময়কার অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডারের চাইতে ২৩ শতাংশ রান বেশি করেছে এই ত্রয়ী। ৪৮-৫৮ এই দশকে মিডল অর্ডারে কমপক্ষে ২০০০ রান করা ব্যাটসম্যানের গড়ের দিকে সেরা পাঁচ জনের চারজনই উইন্ডিজের। চার নম্বর পজিশনে নেমে ৩০০০ রান করেছেন ক্যারিয়ার শেষে এমন ব্যাটসম্যানের মাঝে উইকসের গড় সর্বোচ্চ (৬৩.৬২)
- উইকস থামলেন
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে ঘরের মাঠে কেনসিংটন ওভালে করলেন ১৯৭, এই মাঠে প্রথম তার। সেই সিরিজের তৃতীয় টেস্টে স্যাবাইনা পার্কে বার্বাডোজের এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান নিজের প্রথম ব্যাটসম্যান নিজের প্রথম সেঞ্চুরিকে নিয়ে গেলেন ৩৬৫ রানে। উত্থান হলো স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের। ৩৩ বছর বয়সে বাইশ গজ ছাড়লেন তিনি।
- ৯৫ বছর ১২৬ দিন
৩৩ বছরে থামা স্যার এভারটন উইকস থামলেন আজ পুরোপুরি ভাবেই। বাবার প্রিয় ক্লাব ছিল এভারটন আর তাই হয়তো ছেলের নাম রাখলেন প্রিয় ক্লাবে নামানুসারে। ১৯৬৭, ফ্রাঙ্ক ওরেল থেমেছিলেন লিউকেমিয়ায় ভূগে আর ২০০৬ এ ক্লাইড ওয়ালকট। বয়সের দিক দিয়ে ব্যাটিং গড়ের মতোই এগিয়ে ছিলেন এভারটন।
ব্রিজ টাউনের ‘থ্রি ডব্লিউজ’ ওভালের পাশে সমাধি দেয়া হয়েছিলো ওরেলকে, এর পাশেই ওয়ালকট আর একটা জায়গা খালি আছে স্যার উইকসের জন্য। পরিবার চাইলে সেইখানেই শায়িত হবেন তিনি। ক্রিকেট মাঠের থ্রি ডব্লিউজ পরকালেও থাকবেন পাশাপাশি। ভালো থাকবেন স্যার। পরকালে থ্রি ডব্লিউজের ব্যাটিং দেখার অপেক্ষায়।