তামিলনাড়ুতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি কে? ভোটে দাঁড়ালে রজনীকান্তকে কি হারাতে পারবেন মহেন্দ্র সিং ধোনি?
এক টিভি সঞ্চালক তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করছিলেন সুরেশ রায়না আর পার্থিব প্যাটেলের কাছে।
সেই সঞ্চালক চেন্নাইয়ের রাজপথে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়েছিলেন পথচলতি মানুষজনকে। জবাবে সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, নির্বাচনে দাঁড়ালে সাধারণ মানুষের ভোট পড়বে ধোনির দিকেই।
২০১৯ বিশ্বকাপে সেই হৃদয়বিদারক রান আউটের মুহূর্ত অনেকেই ভুলতে পারেননি এখনও। চেন্নাইবাসীও পারেনি। কয়েকজন আবেগপ্রবণ হয়ে সেই সঞ্চালককে সটান জানিয়ে দেন, তাঁদের বৃদ্ধা মা এখনও ভোলেননি রান আউট হয়ে ধোনি কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছেন।
রাতে চেন্নাই ফুটছে। ধোনির সিএসকে আইপিএলের ফাইনালে। ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন, চ্যাম্পিয়ন সুপার কিংস। মহেন্দ্র সিং ধোনি কিং। রাজা।
তাঁর ব্যাট করতে নামার মুহূর্ত কল্পনা করুন। গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়েছে। শব্দব্রহ্ম বোধ হয় ছড়িয়ে পড়েছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী।
নায়কের আউট হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাও ভেবে দেখুন। স্টেডিয়াম নিঝুম। স্তব্ধ হয়ে গেল বুঝি গোটা দেশ। নায়কের ব্যর্থতায় শোকে মূহ্যমান একটা জাতি। এমন ঘটনা কি ঘটেছে কখনও?
ফাইনালে ওঠার পরে ড্রেসিং রুমে ক্যামেরা ধরা হল। ধোনি হাঁটুতে স্ট্র্যাপ বা ব্যান্ডেজ জাতীয় কিছু বাঁধছেন। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই হাঁটুতে ব্যথা। ব্যথা নিয়ে খেলেই ফাইনালে তুলেছেন সিএসকে-কে।
পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হর্ষ ভোগলের এক হাতের মধ্যে ধোনি। গ্যালারি উত্তাল। কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছেন না। ধোনির মুখে স্মিত হাসি। সেই হাসিই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।
ধোনির ভুবনভোলানো হাসি বলে দিচ্ছিল অনেককিছু, অনেককথা।
এক নেতা এক নিমেষে বুঝে গেলেন তিনি জিতে ফেলেছেন সব। তার জন্য তাঁকে কলার তুলতে হয়নি। মুখে মারিতং জগৎ বলতে হয়নি। দলবাজি করার প্রয়োজন পড়েনি। পুরো সিস্টেম ঘেঁটে ঘ করে দিতে হয়নি। অনাব্যশক চিৎকার-চেঁচামেচি করার দরকার পড়েনি। ভীতির হাওয়া ছড়িয়ে দেননি দলের অন্দরমহলে। কটূ কথা বলে সতীর্থের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দেননি।
আমাদের সবারই ক্যাপ্টেন ধোনিকে দরকার। শান্ত-শীতল মস্তিষ্কের অধিকারী একজন ক্যাপ্টেন কুলকে বড্ড প্রয়োজন। জীবনের সব ক্ষেত্রে, সব পেশায়।
যে অধিনায়ক গভীর রাতে তাঁর দরজা খুলে কাছে ডেকে নেবেন সবাইকে। সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবেন। জেতার নীল নকশা বানিয়ে দেবেন। হারের দায় নেবেন নিজের কাঁধে। সাফল্যের পায়েস বিলিয়ে দেবেন সতীর্থদের মধ্যে। দিনের শেষে কাঁধে-পিঠে স্নেহের হাত রাখবেন। যে হাতের পরশে নতুন উদ্যমে লড়ার ইচ্ছা জাগবে। মরে যাওয়া ইচ্ছেরা মনের ভিতরে নতুন করে জেগে উঠবে।
গুজরাটের সঙ্গে ম্যাচটা দেখার সময়ে লক্ষ্য করলাম ধোনি এক ফিল্ডারকে ইশারা করে দেখাচ্ছেন, ‘বড় করে দম নাও। তার পরে দম ছাড়ো।’ বলতে চাইলেন টেনশন করো না।
ওই দম নাও, দম ছাড়ো দেখে মনে পড়ে গেল আনন্দবাজার পত্রিকার অলনাইন বিভাগের শ্রদ্ধেয় সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা।
একদিন আমার এক সতীর্থকে তিনিও ধোনির মতোই বড় করে দম নিয়ে দম ছাড়ার কথা বলেছিলেন। টেনশন ফ্রি থাকার পরামর্শ হিসেবে ওভাবে দম নাওয়া, দম ধরে রাখা, দম ছাড়ার কথা বলেছিলেন অভিজ্ঞ সাংবাদিক।
এক তরুণ বোলার ভুল লাইন-লেন্থে বল করে বাউন্ডারি দিলেন ম্যাচের মোক্ষম সময়ে। ধোনি ইশারা করে তাঁকে দেখালেন, ‘অফসাইডে সবাই দাঁড়িয়ে, তুমি লেগসাইডে কেন বল করলে?’
ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন, ‘ধোনিকে যতটা চিনি, তাতে আজ আর সতীর্থদের ভুলভ্রান্তি নিয়ে কাটাছেঁড়া করবে না। আহমেদাবাদ যাওয়ার পথে বিমানে বসে সবাইকে পরামর্শ দেবে।’
গুজরাট অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ডিয়া বলে গেলেন, ‘চেন্নাই ১৭২ রান করেছে। কিন্তু এমএস-এর নেতৃত্বের জন্য ওই টোটাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯২।’
ক্যাপ্টেন তো এমনই হন। সামনে থেকে দাঁড়িয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। দলের বিপদে বুক চিতিয়ে লড়েন। পালিয়ে যান না।
হার্দিক পাণ্ডিয়াকে কেবল বুদ্ধি দিয়ে আউট করলেন ধোনি। অফ সাইড পুরোদস্তুর ঘিরে দিয়েছিলেন। পাণ্ডিয়া ফাঁদে পা দিয়ে বসলেন।
সিএসকে ততক্ষণে জয়ের গন্ধ পেয়ে গিয়েছে, তখনও দলের অনভিজ্ঞ বোলার ওয়াইড করছেন। ধোনি শান্ত। মুখে একটা হাসির রেশ ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি নিজে বলছেন, ‘খেলতে নামার আগে ফিল্ডারদের বলে দিই তোমরা শুধু আমাকে অনুসরণ করো। আমি কী বলছি, সেটা ফলো করো। তাহলেই হবে।’
প্রতিটি বলের আগে, প্রতি ওভারের শুরুতে, ওভারের মাঝে ধোনিকে অনুসরণ করছিল ক্যামেরা। দেখছিলাম ধোনি সবসময়ে ব্যস্ত। সারাক্ষণ কী যেন হিসেব করে চলেছেন। হাত নাড়ছেন ফিল্ডারদের দিকে। ইশারায় কথা বলছেন তাঁদের সঙ্গে। খেলার শেষে চেন্নাইয়ের সবাই যখন বুক বাজাচ্ছেন, লাফাচ্ছেন, ধোনি তখনও আশ্চর্যভাবে শান্ত।
এই ম্যাচের আগে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ধোনির সঙ্গে নাকি ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে জাদেজার। পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জাদেজাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা লড়াই থাকলে এতটা প্রশংসা কি কেউ করতে পারেন?
একেকটা দলে প্রতিষ্ঠিত বোলারদের ভিড়। ধোনির হাত ধরে অখ্যাত অনামী বোলারই নামী হয়ে গিয়েছে সিএসকে-তে। আইপিএলের ইতিহাস সেরকমই বলছে। ধোনি বলছেন, ‘প্রতিভা বিকশিত হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দিয়েছি। সবাইকে গাইড করার চেষ্টা করেছি।’
এরকম একজন অধিনায়কের নেতৃত্বেই তো খেলতে চান সবাই। কী জীবনের মাঠে, কী খেলার মাঠে! কিন্তু সবার ভাগ্য কি সমান হয়? ক্যাপ্টেন হিসেবে ধোনিকে কি পান সবাই?
বাকিদের তো রাজা সাজা, এমএস ধোনিই আসল রাজা।