২০১৬ সালে জন্ম নেওয়া সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেড বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর মধ্যে প্রথম পেশাদারিত্ব নিয়ে আসে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) কাছে আবেদন করে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশীপ লিগে (বিসিএল) খেলে তার পেশাদার লিগে প্রবেশ করে। ২০১৭ সালে সেই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথ ধরেই আগমন ঘটে বসুন্ধরা কিংসের। ২০১৮ সালে বিসিএলে শিরোপা জিতে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) জায়গা করে নেয়।
সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের মালিকানায় রয়েছে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। ঠিক তেমনি বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে কিংস নামধারী ক্লাবটি। সারা দুনিয়াতেই পেশাদারী মনোভাবাপন্ন ফুটবলই যখন অগ্রগন্য সেখানে বাংলাদেশ ঠিক তার উল্টো পথে হাটছে। ব্যতিক্রম বসুন্ধরা কিংস আর সাইফ এসসি। ক্লাবের অবকাঠামো থেকে শুরু করে সবকিছুই পেশাদারী অবকাঠামোয় পরিচালিত হয়ে থাকে।
দুটি ক্লাবই পেয়েছে এএফসি ক্লাব লাইসেন্স। পেশাদার লিগের দলবদলের একেবারে শেষদিকে ট্রান্সফার ফি’র মাধ্যমে জাফর ইকবালকে মোহামেডানের কাছে বিক্রি করে দেয় সাইফ। দেশের ফুটবল ইতিহাসে এটি প্রথম ঘটনা। পুরোপুরি পেশাদারিত্ব বজায় রেখেই এমনটি করা হয়েছে। যা বাংলাদেশে অনেকটাই অকল্পনীয় ব্যপার।
সে কথাই ক্লাবটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্চিনিয়ার নাসিরউদ্দিন চৌধুরী বলছিলেন, ’শুরুতে বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হলেও এখন সাইফ স্পোর্টিং পুরোপুরি পেশাদারী কাঠামোয় পরিচালিত হচ্ছে। যারা ফুটবল ক্লাব চালায় তারাই মূলত এটি দেখভাল করে থাকেন। আমরা শুধু পেছন থেকে তাদের সহায়তা করে থাকি’। বসুন্ধরা কিংস তো আরও বেশি পেশাদারী। কর্পোরেট হাইজ থেকে ক্লাবে রুপান্তিরিত হওয়ার পর রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। নিজেদের স্পোর্টস কমপ্লেক্সই এর বড় প্রমাণ।
গত বছর প্রথমবারের মতো এএফসি কাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় ষ্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আবহ তৈরি করা হয়েছিল। মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টস ক্লাবকে আতিথ্য দিতে লাল গালিচার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইউরোপের আদলে যেমন মাঠকে সাজানো হয়েছিল ঠিক তেমনি স্বাগতিক দলের কাছে অতিথি দল পেয়েছে দারুণ আতিথেয়তা। ৫-১ গোলের দারুণ জয় দিয়ে ভাল কিছু ইঙ্গিত দিলেও করোনা কেড়ে নেয় সবকিছু।
কয়েকদফা পেছানোর পর অবশেষে বাতিল করা হয় এশিয়ার ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের আসর। বিপিএলের প্রথম আসরে ফেডারেশন কাপের শিরোপা জিততে না পারলেও লিগ ও স্বাধীনতা কাপের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে তারা। এবার টানা তৃতীয়বারের মতো মৌসুম শুরুর টুর্নামেন্টের ফাইনালে জায়গা করে নিয়ে বসুন্ধরা। সেখানে জমজমাট লড়াইয়ের আভাষ এরই মধ্যে মিলেছে। দারুণ খেলে অপরাজিত থেকে দুটি ক্লাবই শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের নিজেদের তৈরি করেছে। এখন শুধূ মাঠে নামার অপেক্ষা।
এবারের ফেড কাপের শিরোপা যে দল জিতবে তারাই এএফসি কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। প্রথমবারের মতো ফেডারেশন কাপের ফাইনালে খেলার সুযোগ পেয়ে উৎসবটা ঠিকঠাক করতে পারেনি সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব। সেমিফাইনালে চট্টগ্রাম আবাহনীকে ৩-০ গোলে হারানোর পর পল পুটের দলের ড্রেসিংরুম বিষাদে ছেয়ে যায় আল আমিনের পা ভেঙে যাওয়ায়। চট্টলার দলটির চার্লস দিদিয়েরের সাথে সংঘর্ষে অপারেশনের টেবিল পর্যন্ত যেতে হয়েছে তাঁকে।
যদিও এখন শঙ্কামুক্ত তিনি। ক্লাবের জন্য এই শোককে শক্তিতে রুপান্তিরত করে ফাইনালে মাঠে নামবে সাইফ। প্রতিপক্ষ হিসেবে টানা তিনবারের ফাইনালিষ্ট বসুন্ধরা কিংস। এর মধ্যে ২০১৮ সালে রানার্সআপ হলেও সর্বশেষ আসরের শিরোপা জিতেছিল অস্কার ব্রুজোনের দল। এবারো শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে পরিস্কার ফেবারিট তারা। তবে সাইফ এসসিও ছেড়ে কথা বলবেনা। গোল গড়ে প্রতিপক্ষ দলগুলোকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে রিয়াদুল হাসান রাফির দল। শুধুমাত্র কোয়াটার ফাইনালে কষ্ট করে জিততে হয়েছে। মোহামেডানের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ের খেলা ২-২ গোলে ড্র থাকার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও এই স্কোর থাকে। এরপর টাইব্রেকারে সাডেন ডেথে ৭-৬ গোলে জিতে শেষ চারের টিকিট পায় তারা।
আর সেমিফাইনালে মারুফুল হকের দলকে নিয়ে ছেলেখেলাই করেছে সাইফ এসসি। অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংসও শ্রেয়তর দল হিসেবেই ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে। গ্রুপ পর্বে রহমতগঞ্জ, ও চট্টগ্রাম আবাহনীকে হারিয়ে অপরাজিত থেকে শেষ আটে খেলার ছাড়পত্র পায়। যেমন করে অপরাজিত সাইফও। সে হিসেবে যে দল জিতবে তারাই পাবে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নের তকমা। কোয়াটার ফাইনালে শেষ জামালকে পরাজিত করার পর সেমিফাইনালে প্রবল প্রতিদ্বন্ধী আবাহনী লিমিটেডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পায়। ঘটনাবহুল এই ম্যাচটি হয়ছে দারুন উত্তেজনাপূর্ণ। ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে অতিরিক্ত সময়ে। সেখানেই বিজয় মালা গলায় পড়েছে জায়ান্ট দলটি।
এবারের ফাইনালে সবচেয়ে বড় লড়াইটা হবে দুই কোচের। বেলজিয়ান পল পুটের সাথে স্পেনের অস্কার ব্রুজোনের। টুর্নামেন্টের ২১ ম্যাচ শেষ, বাকি আছে আর মাত্র একটি ম্যাচ। এই একটি ম্যাচেই নির্ধারণ হবে কার হাতে উঠছে সেই স্বপ্নের চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। প্রথমবারের মত স্বপ্নের ফাইনালে পা দেওয়া সাইফ এসসি অবশ্যই চাইবে স্মরণীয় একটি ম্যাচ খেলতে। অন্য দিকে বিগ বাজেটের বসুন্ধরা কিংসের প্রত্যাশা টানা দুই বার ফেডারেশন কাপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি কাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এর আগে দুই কর্পোরেট দল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে দুইবার মুখোমুখি হয়েছিল, সেখানে অবশ্য জয় বসুন্ধরার।
২০১৯ সালের ১১ই এপ্রিল বসুন্ধরার ঘরের মাঠে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবকে ৩-২ এবং দ্বিতীয় লেগে ২-০ গোলে হারিয়ে জয় পায় ঢাকার ফুটবলের এই নবশক্তিরধর দলটি। তবে সব পরিসংখ্যানকে থোরাই কেয়ার করে ফাইনালে জয়ে চোঁখ রাখছেন পল পুট, ’যেহেতু আমার দল ফাইনালে উঠেছে তাই শিরোপা জয় ছাড়া অন্যকিছু ভাবছিনা। ফাইনাল ম্যাচে যেকোন কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই খেলোয়াড়দেরকে আমি সেভাবেই তৈরি করেছি। মাঠ কোন সুযোগ হেলায় হারানো যাবেনা। তাহলেই জয় পাওয়া সহজ হবে’।
অন্যদিকে সেরা দল নিয়েই সাইফ এসসির মোকাবেলা করতে নামার অপেক্ষায় বসুন্ধরা। দলটির কোচও আত্ববিশ্বাসী শিরোপা জয়ের ব্যপারে, ’সেমিফাইনালে সবচেয়ে বড় ভয়টা ছিল আবাহনীকে নিয়ে। ছেলেরা স্নায়ু চাপের সেই ম্যাচটা দারুনভাবে জিতেছে। এতে আত্ববিশ্বাস বেড়ে গেছে কয়েকগুন। টুর্নামেন্টের আগে থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং সে লক্ষ্যের একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আর একটি মাত্র ম্যাচ, এটা জিতলেই চ্যাম্পিয়ন হবো। ছেলেরা সেরাটা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব তরুণ দল হলেও ওদের কোচ বিশ্বমানের। তারাও প্রতিদ্বন্ধিতা গড়ে তুলতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস’।
দারুণ ফর্মে থাকা সাইফ এসসি’র মূল ভরসা দলের নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড ইউচেকু কেনেথ। পাঁচ গোল করেন এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। এছাড়া আরেক নাইজেরিয়ান ইমানুয়েল ইকেচুকো ডিফেন্ডার হয়েও দুই গোল করে দলকে ফাইনালে তুলতে অবদান রেখেছেন। এছাড়া দেশী অভিজ্ঞ রহমত মিয়া, অধিনায়ক রিয়াদুল হাসান রাফি, তরুণ ফয়সাল আহমেদ ফাহিম, আরিফুর রহমানদের নিয়েই ফাইনালের জন্য মাঠে নামার অপেক্ষায় রয়েছে তারা।
অন্যদিকে পুরা টুর্নামেন্টে মাত্র এক গোল হজম করা বসুন্ধরা কিংসের এবারের ভরসার নাম চার বিদেশি রবসম ডা সিলভা, জনাথন ফার্নান্দেস, রাউল বেচাররা ও খালেদ শাফি। ডিফেন্স থেকে মিডফিল্ড ও আক্রমণ ভাগ, সবকিছুই যেনো এই চার জনের আধিপত্য। তিন লাতিন ফুটবলার নিজেদের ফুটবল সৌন্দর্য্যরে মেলা বসিয়ে সব আলো নিজেদের দিকে করে নিয়েছেন।
বসুন্ধরা কিংসের প্রতি ম্যাচেরই জয়ের নায়ক এই তিন লাতিন ফুটবলার। হার্নান বার্কোসের বদলি হিসেবে আনা আর্জেন্টাইন রাউল বেচাররা আস্থার প্রতিদান দিয়ে চলেছেন। পাচ ম্যাচে চার গোল করে প্রমাণ করেছেন বার্কোসের চেয়ে কোন অংশে কম নন তিনি। এছাড়া দেশী তপু বর্মন, মাশুক মিয়া জনি, মতিন মিয়া, মোহাম্মদ রিমনরা শিরোপা জয়ের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের দারুণ একটা ম্যাচ উপভোগের অপেক্ষায় ঢাকার দর্শকরা।