সাগরিকায় দমকা হাওয়া আসে প্রায়ই। ৬ জুলাইয়ের আকাশটাও ছিল মেঘলা। তবে সে সব কিছু ছাপিয়ে চট্টলা যেন ভারাক্রান্তময় শহর হয়ে উঠল ভিন্ন এক দমকা হাওয়ায়। একটি ঘোষণা। অশ্রুসিক্ত বিদায়ের ঘোষণা। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে বাইশ গজ থেকে এক বর্ণিল ক্রিকেটারের প্রস্থানের ঘোষণা। বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন আজই।
গত বছরের ১৬ জুলাই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছিলেন তামিম। এবার ওয়ানডে ও টেস্ট থেকেও অবসরের ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এই ব্যাটার।
২০০৭ থেকে ২০২৩। ১৬ বছরের এ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার কেমন ছিল? বাংলাদেশের হয়ে সব ফরম্যাট মিলিয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাই তো একটা সারমর্ম তৈরি করে দেয়। তবে দীর্ঘ এ যাত্রায় উত্থান পতন তো ছিলই। সে সব চড়াই-উতরাই পেরিয়েই তামিম ইকবাল দেশের ক্রিকেটে একটা নিজস্বতার ছাপ এঁকেছেন। যার পদাঙ্ক অনুসরণ করে উঠতি ক্রিকেটাররা পেতে পারেন অনুপ্রেরণার সব রসদ।
ব্যাট-বলের সাথে তামিমের বেড়ে ওঠা ২০০৫ সালে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান তিনি। সেখান থেকেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সূচনা। এরপর বিভাগীয় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অসাধারণ পারফরম্যান্সের সুবাদে সেই বছরই তিনি অনুর্ধ্ব-১৯ দলের আফ্রো-এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টে ডাক পান। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা পড়তে আর বেশি সময় বিলম্ব হয়নি।অনুর্ধ্ব-১৯ দলে অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ জাতীয় দলে ডাক পান তামিম ইকবাল।
২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। এক দিনের ক্রিকেট দিয়েই এ দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তামিমের। দেশের ৮৩ তম ওয়ানডে ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করা তামিম অবশ্য সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি অভিষেক ম্যাচ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সে ম্যাচে ৮ বলে মাত্র ৫ রান করে অ্যান্থনি আয়ারল্যান্ডের বলে গ্রে ব্রেন্টের হাতে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। যদিও সে ম্যাচটি বাংলাদেশ ১৪ রানে জয়লাভ করেছিলো।
অবশ্য বিবর্ণ শুরু হলেও তামিম ইকবাল ক্রমান্বয়ে ঠিকই পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে নিয়ে যান। ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে চোখে পড়ার মতো কিছু না করলেও নির্বাচকরা তার উপর ভরসা রেখেছিল ঠিকই। আর সেই আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন তিনি। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে জহির খানদের মতো বিশ্বসেরা বোলারদেরকে চোখ রাঙিয়ে দাপটের সাথে ব্যাট করেছিলেন। পোর্ট অফ স্পেনে সেই ম্যাচে তামিম ইকবাল ৫৫ বলে ৭ চার আর ২ ছক্কায় ৫১ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিল।
বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে তামিম ইকবালকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ জাতীয় দলে তার অবস্থান পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়ায় বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় অভিষেকের এক বছর পরই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৬ বলে ১৫টি চার ও ১টি ছক্কার সুবাদে ১২৯ রান করে ক্যারিয়ারের প্রথম শতকের দেখা পান তিনি।
এরপরই বাংলাদেশের ওপেনিং স্লটে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠেন তামিম। যদিও ২০১১ বিশ্বকাপের পর একটু নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল তাঁর জায়গাটা। তবে ২০১২ এশিয়া কাপে টানা ৪ ম্যাচে ৪ ফিফটি হাঁকিয়ে সব সমালোচনার জবাব দেন তিনি।
তামিম ইকবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন এই সংস্করণের ক্রিকেট খেলেই। আফগানিস্তানের বিপক্ষে নিজের ঘরের মাঠে এই সংস্করণেই তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেন তামিম। ২৪১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩৬.৬২ গড়ে ৮৩১৩ রান করেছেন, সেঞ্চুরি ১৪টি, ফিফটি ৫৬টি। রান, সেঞ্চুরি এমনকি ফিফটি, সব কিছুতেই যা বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
কম যান না টেস্টেও। লাল বলের ক্রিকেটে ৭০ ম্যাচে ৩৮.৮৯ গড়ে ৫১৩৪ রান করেছেন তামিম। ১০ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন ৩১ টি ফিফটিও। এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ও সেঞ্চুরির রেকর্ড তাঁর। তবে বাংলাদেশি ব্যাটার হিসেবে লর্ডসের মাটিতে সেঞ্চুরি করার কীর্তিটা কিন্তু শুধু তামিমের একারই। শুধু তাই নয়, যে বছরে লর্ডসে সেঞ্চুরি করে অনার্স বোর্ডে নাম লেখালেন, সেই ২০১০ সালে তিনি ৭ ম্যাচে ৫৯.৭৮ গড়ে মোট ৮৩৭ রান সংগ্রহ করেছিলেন। যার সুবাদে সে বছরে তাঁর হাতে উঠেছিল উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার।
টি-টোয়েন্টিতে ৭৪ ম্যাচে ১৭০১ রান করেছেন তামিম। তবে অনন্যতা হলো, একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে তিনিই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করেছেন। আর সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫ সেঞ্চুরি করা তামিম তিন ফরম্যাট মিলিয়ে করেছেন ১৫ হাজারের বেশি রান। দেশের আর কোনো ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত রান করতে পারেননি।
একদিন আগেও তামিম ইকবাল ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। আসন্ন বিশ্বকাপেও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল তাঁরই। কিন্তু তা আর হলো কই! সমালোচনা, অপ্রকাশিত কিছু অভিমানেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন তামিম। এমন বিদায় তো বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটা দমকা হাওয়ায় বটে।
কারণ মাশরাফি, রিয়াদ, সাকিব, তামিম, মুশফিক, এই পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে তামিমই তো প্রথম যিনি বিদায় বললেন। অবশ্য তামিম তো দেশের ক্রিকেটের অর্জনে, গর্জনে কীর্তিতে, অনেক কিছুতেই ‘প্রথম’। এবারের ‘প্রথম’ টা বোধহয় বিধুরতাতে পূর্ণ হয়ে উঠলো। দৃশ্যপট হয়ে উঠলো, অশ্রুসিক্ত তামিমের বলা সেই কঠিন কথাটা, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই সঠিক সময় সরে দাঁড়ানোর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে।’