সিরিজ শুরুর আগের কথা। বিরাট কোহলি আর স্টিভেন স্মিথের সাক্ষাৎকার হচ্ছে। সেই সাক্ষাৎকারে কোহলি দুইজনের কথা বললেন। প্রথম টেস্টের পরে তিনি থাকবেন না। তারপর তাঁর অনুপস্থিতিতে আজিঙ্কা রাহানে কীভাবে অধিনায়কত্ব করেন সেটা তাঁর (রাহানের) জন্য একটা বড় অপরটুনিটি, আর তিনি অধীর আগ্রহে বসে আছেন যে হনুমা বিহারি কীভাবে এই সিরিজটা খেলেন।
বিহারিকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা। প্রথম টেস্টে ভারত পেলো ৩৬ রানের লজ্জা। সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে অধিনায়কত্ব করতে হয়- তাঁর প্রায় সবটা দেখিয়ে ভারতীয় তথা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কামব্যাক লিখেছিলেন আজিঙ্কা রাহানে আর তার ভারত।
কিন্তু প্রথম দুই টেস্টে হনুমা বিহারি সেরককম কিছুই করতে পারেননি। সিডনি টেস্ট ছিল তাঁর পরীক্ষার নাম। প্রথম ইনিংসেও ৪ রানে রান আউট হয়েছেন। তাঁর জায়গায় ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে রিশাভ প্যান্ট যখন ম্যাচটাকে ভারতের জয়ের প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন তখন নেমেছেন।
বেশি না রানের চাকাটা তিনের আশাপাশে সচল রাখলেই ইতিহাস সৃষ্টি হতে পারে। এমন অবস্থায় ৩ রানে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান পড়লো। এই অবস্থায় অন্য যে কেউ হয়তো মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু দলের কার্যত শেষ স্বীকৃত ব্যাটিং জুটিতে তখন আছেন বিহারি আর পূজারা। ভিহারি থাকলেন। এরপর কী হবে সেটা কেউই তখন জানতো না, জানতেন না বিহারিও।
ওইদিকে পূজারা আছেন ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে।
আবার বিরাট কোহলিতে ফিরে যাই। তিনি কপিল শর্মার কমেডি শোতে গিয়ে বলেছিলেন, ভারতীয় দলের সবচেয়ে ভদ্র ক্রিকেটারটার নাম চেতেশ্বর পূজারা। নামও পূজারা, স্ত্রীর নামও পূজা। সারাদিন পূজা করে, ভদ্র থাকে। কোন ধরনের বদভ্যাস নাই! ব্যক্তিজীবনের এই বদভ্যাসহীন পূজারা সম্ভবত ঋষি পর্যায়ের।
টি-টোয়েন্টির এই রমরমা যুগে সবাই যখন গ্ল্যামারের ঝনঝনানিতে আছে তখন পূজারা একমনে তাঁর দিকের কাজটা করে যান চরম মনোযোগে। পঞ্চম দিন সকালে ভারত জানতো যে সারাদিন ৩০৯ রান করতে গেলে একদিকে উইকেট আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। পান্ত রান তোলার কাজটা খুব ভালো করছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে পূজারার তাতে কোন বিকার নেই।
ঋষভ পান্ত নাথান লিওঁকে ডাউন দ্য উইকেটে ছক্কা মারেন, কামিন্স, স্টার্কদেরকে পুল করেন, ড্রাইভ খেলেন, লফটেড মারেন। অন্যদিকে প্রায় একই ধরনের বল পূজারা স্রেফ ছেড়ে দিচ্ছেন! তাঁর ধ্যানের ২২ গজে তিনি অন্য সব প্রভাব থেকে মুক্ত। তিনি শুধু জানেন যে টিকে থাকতে হবে। তবু শেষ রক্ষা হলো না। হ্যাজলউডের একটা স্যুইংয়ে লাইন মিস করে বোল্ড হলেন।
এর আগে ঋষভ পান্তের গল্পটা একটু বলে নেই। গত কয়েক দশকের সেরা উইকেট কিপার ঋদ্ধিমান সাহাকে সরিয়ে দলে এসেছেন শুধু ব্যাটিংটার কারণে। কিপিংটা যে যুতসই না সেটা তিনিও জানেন। প্রথম ইনিংসে দুইটা নিশ্চিত ক্যাচ ছেড়েছেন! সাহার জায়গায় দলে আসা তাই প্রশ্নবিদ্ধই হয়েছিলো। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করার সময় হাতে ব্যাথা পেয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে কিপিং করতে পারেননি। ওই ব্যাথা নিয়েই ব্যাটিংয়ে নেমেছেন।
পুরো ইনিংসে হাতে এমন ব্যাথা ছিল যে হাত তুলে পানি খেতে পারছিলেন না। ড্রিংক্স ব্রেকে যখন অতিরিক্ত খেলোয়াড় পানি নিয়ে আসছিলো প্যান্টকে পানি খাইয়ে দিচ্ছিলো, যেন প্যান্টকে পানির বোতল উঠানোর জন্যেও হাত নাড়াতে না হয়। যেন প্যান্ট তাঁর হাতটা শুধু ব্যাটিংয়ের জন্যই নাড়ান! অনেক শক্তিশালী পেইন কিলার ট্যাবলেট খাচ্ছিলেন!
প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়েই কামিন্স, হ্যাজলউডদের বাউন্সগুলোতে হাতটা ভালোই নাড়িয়েছেন। স্ট্রোক প্লের পসরা সাজিয়ে ১১৭ বলেই করেছেন ৯৭ রান! রানটা এমন দ্রুতগতিতে তুলেছেন যে তিনি যখন আউট হন তখন ভারতের ওভারপ্রতি রানের প্রয়োজনটা তিনে নামিয়ে দিয়ে গেছেন!
পূজারা বোল্ড হবার পরে যখন শ্বিন নামলেন ততক্ষণে বিহারি দৌড়াতে পারছেন না। শ্বিনও ইনজুরিতে জর্জর। আগের রাতে সারারাত বিছানায় পিঠ ঠিকভাবে দিতে পারেননি। স্ত্রী প্রীতি বলেছেন যে অশ্বিন নাকি জুতার ফিতা বাঁধার জন্য পিঠ যে বাঁকা করতে হয় সেটিও করতে পারছিলেন না। ড্রেসিংরুমে বসতে পারছিলেন না। সেই শরীর নিয়েই নামলেন।
ফিজিও নামতে দেখা গেলো অশ্বিনের শরীরে টেপ পেঁচানো। ওইদিকে পিছন দিয়ে টিম পেইন স্লেজ করে যাচ্ছেন, অশ্বিন ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছেন। আবার মুখ ঘুরিয়ে বিহারিকে তামিলে কিছু একটা বলছেন! কিন্তু মনোযোগে কোন ফাটল নাই!
অন্যদিকে বিহারিও একের পর শক্তিশালী পেইন কিলার খেয়েছেন। একেকবার পানির বোতল নিয়ে অতিরিক্ত খেলোয়াড়েরা এসে বিহারিকে একেকটা পেইন কিলার ট্যাবলেট খাইয়ে গেছেন। একটা সময় দেখা গেলো তাঁর রান ১০০ বলে ৬, ১২৪ বলে ৭!
একদিকে বিহারি সিঙ্গেলস মানা করে দিচ্ছেন, অন্যদিকে অশ্বিন মানা করছেন। একের পর এক ওভার মেডেন যাচ্ছে। কামিন্স, স্টার্করা তাঁদের সব নিংড়ে দিচ্ছেন শরীর বরাবর। বিহারি আর অশ্বিন যেন দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ন্যূনতম ৪০ টা সিঙ্গেলস তাঁরা নেন নাই, ডাবলস নেন নাই। সেগুলো নিতে পারলে যে ৪০৭ রানের চেজটা আরও উপভোগ্য হতো না, ইতিহাস সৃষ্টি হতো না – সেটা কে বলতে পারে!
তাঁরা যখন ব্যাটিং করছেন তখন তাঁদের মনোবল বাড়াতেই কিনা হঠাৎ দেখা গেলো রবীন্দ্র জাদেজা ড্রেসিংরুমে প্যাডআপ করে বসেছেন। জাদেজাও হাত ভেঙেছেন প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে গিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে বল করেননি। জাদেজার এই প্যাড আপ ব্যাটসম্যানদের যতটুকু না বার্তা দিলো তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বার্তা দিলো প্রতিপক্ষকে। এরা ভাঙলেও মচকায় নাই! এই যে মোরাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলা, এটার নামই টেস্ট ক্রিকেট!
জয় ভটাচার্য টুইট করেছেন, ‘এরা ক্রিকেট ইলেভেন থেকে হসপিটাল ওয়ার্ড হয়ে গেছে! তবু ফাইটিং ছাড়ছে না!’
তবে বিহারি আর আশ্বিন সিঙ্গেলস না নিতে পারলেও টিকে ঠিকই রইলেন। প্রায় ৪৩ ওভার ব্যাটিং করে অসম্ভব এক ম্যাচ বাঁচিয়ে দিলেন ভারতের জন্য।
অথচ এই ম্যাচটা শুধুই এই শেষদিনের ভারতের ব্যাটিং বীরত্বের হবার কথা ছিল না। এই ম্যাচটা অনেক বেশি হবার কথা ছিল স্টিভেন স্মিথের। পুরো ২০২০ সালে কোন সেঞ্চুরি নেই। ‘স্মিথের রিফ্লেক্স কমে গেছে’- এই ফিসফাস উঠে গিয়েছিলো। স্মিথ জবাব দেবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন প্রিয় সিডনিকে।
প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করে নিজের ফিরে আসার জানান দেবার পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও ৮১ করেছিলেন। লাবুশেনটাও প্রথম দুই টেস্টের ব্যর্থতা ভুলে ৯১ আর ৭৩ করেছেন। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দুই গড়ের (ব্র্যাডম্যান ধর্তব্য না) ব্যাটসম্যানের কাম্ব্যাক টেস্ট অস্ট্রেলিয়ারই হবে এই আশা ছিল।
অথচ সিডনি তো বসে থাকে রোমাঞ্চ আর নানা রঙের ঘটনা নিয়ে। সেই ২০০৭-০৮ এও এমন হয়েছিলো। সেবারের সিডনি টেস্টেও এমন রঙের মেলা বসেছিলো। একটার পর একটা বিতর্কিত আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত আর অস্ট্রেলিয়ানদের টাফ ব্যবহার দেখে অনিল কুম্বলে সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছিলেন, ‘শুধু একটা দলই স্পিরিট অফ দ্য গেমের নিয়ম মেনে টেস্টটা খেলেছে!’
বলা হয় যে আইসিসির ক্রিকেট মেরুকরণ ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটা ফাইনাল পেরেক ছিল সেই ২০০৭-০৮ এর সিডনি টেস্ট! সেটা অন্য গল্প! তবে রঙের কথায় মনে হলো সেই টেস্টের সময়েও বর্ণবাদের থাবা এসেছিলো! হরভজন-সাইমন্ডসের মাঙ্কিগেট কেলেঙ্কারি ওইসময়েই।
অনেকটা ঘটনা মিল রাখতে হবে বলেই কিনা এই টেস্টে আসলো বর্ণবাদের থাবা। গ্যালারির দর্শকেরা ভারতীয় বোলার সিরাজ-বুমরাহকে বর্ণবাদী কথা বলায় নজিরবিহীনভাবে আম্পায়ার খেলা বন্ধ করে সিকিউরিটি ডেকে দর্শকদের মাঠ থেকে বের করে দিলেন!
তবে ‘দেজা ভ্যু’ এর এই কাণ্ড ক্রিকেটে ঘটলে বোধকরি অজিরা আরও খুশি হতো। সেবার দিনের মাত্র ২ ওভার বাকি থাকতে ভারতের হাতে তিন উইকেট ছিল ম্যাচ ড্র করবার জন্য। মাইকেল ক্লার্কের এক ম্যাজিক্যাল ওভার এক ওভারেই ভারতের তিন উইকেট নিয়ে নিয়েছিলো। সাংবাদিক বিক্রান্ত গুপ্তা বলেছিলেন, ‘ওই ঘটনার পরে প্রেসবক্সে ভারতীয়রা যারা বসে ছিলেন কেউ জায়গা থেকে ওঠার শক্তি পাচ্ছিলেন না।’
যাই হোক, কামিন্স, স্টার্ক, হ্যাজলউড, লিওঁদের নিয়ে গড়া বিশ্বসেরা বোলিং লাইনআপ কেবল শর্ট বল না করে কয়েকটা বল গুড লেংথ বা ফুল লেংথে করলে কী হতো, নাথান লায়ন কয়েকটা ফ্লাইট দিয়ে আশ্বিনকে প্রলুব্ধ করতে পারতেন কিনা- সেসব প্রশ্ন করাই যায়! তবে, ম্যাচ রোমাঞ্চ তাঁর সব নাটকের পসরা সাজিয়ে ২০২১ এর সিডনি টেস্টের জন্য বসে ছিল ঠিকই। কিন্তু হনুমা বিহারি, রবিচন্দ্রন অশ্বিনেরা সেই নাটকটা হতে দেননি।
এই টেস্টে তাই স্টিভেন স্মিথ শেষ পর্যন্ত ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হলেও, টেস্টটা স্মিথ, লাবুশ্যানদের কামব্যাকের হয়নি, বিতর্কের খোড়াক যোগানোর জন্য, মিডিয়ার জন্য ‘বর্ণবাদের’ খবরেরও হয়নি। ম্যাচটা হয়েছে, টেস্ট ক্রিকেটে কঠিন মানসিক দৃঢ়তা প্রমাণের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ! টেস্ট ক্রিকেটের এক আদর্শ বিজ্ঞাপন!
৩৬ রানে অলআউট হওয়া দলটা নানাভাবে খেলোয়াড় হারিয়ে পরের দুই টেস্টেই যে চরিত্র দেখালো তাতে ব্রিসবেন টেস্টের ফল এখন গৌণ! ভারত সুন্দরেসানের টুইটটা দিয়ে শেষ করি, ‘ইফ টেস্ট ক্রিকেট ইজ অল অ্যাবাউট ক্যারেক্টার, ইন্ডিয়া হ্যাজ অলরেডি ওউন টুডে।’
শেষ করে মনে হলো আজকে ‘দ্য ওয়াল’ রাহুল দ্রাবিড়ের জন্মদিন! এমন একটা টেস্টের মাধ্যমে ক্রিকেট তাঁর ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক কুশীলবকে সেরা জন্মদিনের উপহারটাই দিলো!