সিলেটের গ্যালারি তখন ‘সাকিব সাকিব’ গর্জনে মাতোয়ারা। সমর্থকদের ভালোবাসার সেই সুর পৌঁছেছিল সাকিবের কান পর্যন্তও। তার প্রতিদান তিনি দিলেন পরের বলেই।
রশিদ খানের বলে ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশের জয়ের সমীকরণটা ২৩ বলে ২৮ থেকে নামিয়ে আনলেন ২২ বলে ২২-এ। বাংলাদেশের আগাম জয়ের স্বস্তির সুবাসটা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়লো সাকিবের ঐ এক শটেই।
এ দৃশ্য নতুন কিছু নয়। সাকিবের ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে বাংলাদেশের জয়— এমন শিরোনামে বহু গল্প লেখা হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট যদি একটা ইতিহাস হয়, সেই ইতিহাসে সন্দেহাতীতভাবেই ঐতিহাসিক এক চরিত্রের নাম সাকিব।
লাল সবুজ জার্সি গায়ে ২২ গজের ক্রিকেটে ১৭ টা বসন্ত কাটিয়েছেন। কিন্তু কোনো বসন্তেই সাকিবের বাইশ গজের জীবন সাদামাটায় কাটেনি। সাকিব যেন এই ১৭ বছর কাটাচ্ছেন বসন্তের নতুন পাতার মতোই। সময় গড়িয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের এ অন্তঃ-প্রাণ কেন্দ্রীয় চরিত্রেই রয়ে গিয়েছেন।
বসন্তে বনে বনে ধ্বনিত হয় পাতা ঝরার গান। একটু ওমের পরশ পেতেই গাছের ডালে ডালে উঁকি দেয় নতুন পাতা, নতুন কুঁড়ি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন দিনের পথচলাটাও ঠিক চালিত হয়েছে এমনভাবেই। যার নেপথ্যে ঐ ব্যক্তিটিই, সাকিব আল হাসান।
বেশি না, এক বছর আগেই ফিরে যাওয়া। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দল মানেই তখন জীর্ণ শীর্ণ এক দলের নাম। সেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজেই বের করা যাচ্ছিল না। সাকিব সেই দায়িত্বটাই কাঁধে নিলেন। সহসাই সফলতা মিলল না। কিন্তু বার্তা দিলেন দিন বদলের সম্ভাব্যতার।
এক বছরের ব্যবধান। গোটা দলটাই বদলে গেল। বদলে গেল সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থাও। আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এরপর আফগানিস্তান— টানা ৩ টি টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতল বাংলাদেশ।
শেষ ৮ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ৭ টিতে। এর মধ্যে টি-টোয়েন্টির বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ৩-০ তে হোয়াইট ওয়াশ করার সুখস্মৃতি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে ২০২৩ এ এসে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলটা আমূলে পাল্টে গেল।
এক বছর আগে অধিনায়ক সাকিব যে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন তারই প্রতিফলন ঘটল এ বছরে। কখনোই আফগানদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জেতেনি বাংলাদেশ। সাকিবও সেই সত্যটা মেনে নিলেন। কিন্তু সেই পরিসংখ্যানের বিপরীতে মিস্টার সেভেন্টি ফাইভ একটা ‘কিন্তু’ যোগ করে দিলেন— ‘ওরা ফেবারিট। কিন্তু আমরা দুটি ম্যাচই জিততে চাই’।
সাকিবের সেই ‘চ্যাম্পিয়ন’ মানসিকতাতেই বদলে গেল বাংলাদেশ। আফগানদের বিপক্ষে ২-১ এ ওয়ানডে সিরিজ হারা বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতল ২-০ তে।
অধিনায়ক সাকিব তো শুধু ‘অধিনায়ক’ নন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া অদম্য এক নেতার নাম। বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে তাই নিজের পরিচিত চরিত্রটাই আবারো রূপায়ণ করলেন তিনি। অধিনায়ক সাকিবের পাশাপাশি অলরাউন্ডার সাকিবের সত্যিকারের রূপ।
৪ উইকেট আর ৩৭ রান। দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন্সিতে সিরিজ জয়ের পাশাপাশি সিরিজ সেরার পুরস্কারটাও তাই গিয়েছে সাকিবের হাতেই।
বোলিংয়ে ব্রেক থ্রু কিংবা ব্যাটে এসে দলকে এগিয়ে দেওয়া, সাথে আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের মানসিকতার রেশ দলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া— সাকিব পারেন বটে। আর তিনি পারেন বলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায়।
সাকিব, নামটার পাশে ‘রেকর্ড’ শব্দটাই যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। আফগানদের বিপক্ষে এ জয় দিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সব মিলিয়ে ১৭৩ তম ম্যাচ জয়ের স্বাদ পেলেন সাকিব। যা বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে এখন সর্বোচ্চ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড। আগে এ রেকর্ডটি ছিল মুশফিকুর রহিমের। তিনি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে ১৭২ টি ম্যাচ জিতেছেন।
ম্যাচ সেরা আর সিরিজ সেরা, দুটোই হয়েছেন সাকিব। এ নিয়ে ১৭ তম বারের মতো সিরিজ সেরার পুরস্কার নিলেন তিনি। আর এখানেই তো সাকিব রয়েছেন শীর্ষে যাওয়ার দৌড়ে। ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২০ বার সিরিজ সেরা হয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার।
শচীনের মতো ২০ বার সিরিজ সেরা হয়েছেন বিরাট কোহলিও। রেকর্ডবুকে এর পরের নামটাই সাকিব। কে জানে, সাকিব যখন বাইশ গজের মায়া ছাড়বেন, তখন এই তালিকার শীর্ষ আসনটা লেখা হতে পারে তাঁরই নামে।
ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং, অধিনায়কত্ব—সব মিলিয়েই যেন এক পরিপূর্ণ সাকিব। এত কিছুর দায়িত্ব সমান তালে এগিয়ে নেওয়াটা চাপেরই বটে। কিন্তু সাকিব সেই চাপ সামলান নির্লিপ্ততায়, স্মিত হাসিতে। সাকিবের এই চাপ সামলানোর গল্প চলতে থাকুক। চলতে থাকুক বাংলদেশের জয়রথও।