মুম্বাইতে এখন পিরিয়ডিক ছবি বানানো ধুম চলছে। এর মধ্যে বড় একটা জায়গা করে নিয়েছে খেলাধুলা নিয়ে বানানো ছবি। এই খাতে সর্বশেষ সংযোজন-৮৩।
১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের কাহিনী নিয়ে বানানো এই ছবিটি ভারতে বক্স অফিসে সাড়া ফেলতে পারেনি। তারপরও আমাদের কারবার তো ঠিক বক্স অফিস নিয়ে নয়। আমরা বরং একটু ক্রিকেটের জায়গা থেকে ক্রিকেট ইতিহাসের এরকম গুরুত্বপূর্ন একটা কাহিনীকে দেখার চেষ্টা করি। আসলে কেমন হলো ক্রিকেটের এই চিত্রায়ন?
ছবিটা দেখার পর প্রথমেই যে কথাটা মনে হয়েছে, তা হলো-এ আর নতুন কী?
জানি, এই কথাটা নিয়ে আপনারা আপত্তি করবেন। পিরিয়ডিক ছবিতে ‘নতুন কী’ জিজ্ঞাসা করার সুযোগটা কই? এখানে তো আগে থেকে সবকিছু ঘটে আছে। সব ঘটনাই বাস্তবে ঘটে গেছে। তাহলে নতুন করে কিছু করার সুযোগ তো নেই। ভারত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যেখানে হেরে গিয়েছিলো, সেখানে তো জয় দেখানোর উপায় নেই। সুনীল গাভাস্কার পুরো টুর্নামেন্টে রান পাননি; এখন তার ব্যাটে একটা সেঞ্চুরি তো দেখিয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
তাহলে আমি ‘নতুন’ কিছু খুজছি কেন?
খোজার কারণ আছে। আর এই কারণটাই হলো পিরিয়ডিক ছবির আসল ম্যাজিক। এই ধরণের ছবিতে সবাই সবকিছু জানে বলে মনে করা হয়। আসলে অনেকে অনেক কিছু জানে না। প্রকাশ্যে যা যা ঘটেছে, তা তো সবাই জানেই। কিন্তু নেপথ্যে এসব ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা ঘটে, যা লোকেরা সেভাবে জানে না। আর সেসব গল্পই হয়ে উঠতে পারে এই ছবির প্রাণ।
যেমন উদাহরণ হিসেবে আমরা গাভাস্কার-কপিল লড়াইয়ের কথা আনতে পারি। সে সময় এটা ছিলো বিরাট একটা ঘটনা। পর্দার পেছনে এই লড়াইয়ে অনেক কিছু ঘটেছে। ইনফ্যাক্ট কপিলের নেতৃত্ব ভারতীয় দলে তখন প্রশ্নাতীত ছিলো না। সিনিয়রদের কাছে তিনি মোটেও ক্যাপ্টেন ছিলেন না। মূলত তখনকার বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট এন কে পি সালভের সমর্থন ছাড়া তার সেভাবে সম্বল কিছু ছিল না।
এই সালভের কথাই ধরুন না কেন? তাঁকে নিয়ে এই ১৯৮৩ বিশ্বকাপ কেন্দ্রিক রোমাঞ্চকর সব গল্প আছে। এই দলটার ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে একটা দল হয়ে ওঠার যে গল্প, সেটাই হতে পারত এই সিনেমার প্রাণ। তা হয়নি।
তাহলে কী হয়েছে?
যেটা হয়েছে, তা এক কথায় বললে একটু রূঢ় শোনাবে। এটা আসলে ১৯৮৩ বিশ্বকাপের হাইলাইটসের একটা রিমেক হয়েছে। আপনি ইউটিউব ঘুটলে ১৯৮৩ বিশ্বকাপের যা যা দেখতে পাবেন, তার চেয়ে খুব বেশিকিছু এখানে পাবেন না। হ্যা, কপিলের ১৭৫ সরাসরি সম্প্রচার হয়নি। সেটা এখানে দেখে একটু আনন্দ পেতে পারেন; এই আর কী।
এ ছাড়া ধরুন লালা অমরনাথের চরিত্রে মহিন্দর অমরনাথের অভিনয় করা, পিচ্চি শচীনকে একটু দেখানো বা নাওয়াবপুরের দাঙ্গা থামাতে বিশ্বকাপের ভূমিকা, ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের কমেন্ট্রি; এসব ছবিটার একটু আকর্ষণ হতে পারে। আচ্ছা, এই ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের গল্প ধরেই তো কী অসাধারণ স্টোরি লাইন হতে পারতো।
ফারুকের সেই প্রথম বিশ্বকাপ খেলা, প্রায় ইংলিশ হয়ে ওঠা এবং রেসিজমের শিকার হওয়া; সেখান থেকে ফারুকের এই কমেন্ট্রিবক্সের লড়াই। কী অসাধারণ একটা গল্প তো রয়েই গেলো। তা না করে দেখানো হলো হাইলাইটস; চার-ছক্কা আর উইকেট।
দেখুন, ক্রিকেটে একটা কথা আছে যে, যে শুধু ক্রিকেট বোঝে, সে আসলে ক্রিকেট বোঝে না। শুধু চার-ছয়-উইকেট দিয়ে আপনি ক্রিকেটের গল্প বলতে পারবেন না। আপনাকে আসলে এর বাইরে অনেক বড় ক্যানভাসে ভাবতে পারতে হবে। হাইলাইটস কখনো স্টোরি হতে পারে না।
এবার শেষ কথা। এই সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে, তা সব কী বস্তুনিষ্ঠ? মোটেও না।
বিশেষ করে ভারতীয় দলকে যেভাবে আকাশ থেকে পড়া একটা নামিবিয়া টাইপের ছোট দল হিসেবে ১৯৮৩ সালে দেখানো হচ্ছে, ভারত মোটেও তা নয়। হ্যা, ওয়ানডেতে তখনও ভারতের সমীহ তৈরী করার মত ফলাফল নেই। তাই বলে, তারা ক্রিকেটে আউটসাইডার নয়।
এই ১৯৮৩ সালের ঢের আগেই তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংল্যান্ডকে টেস্ট সিরিজ হারিয়ে এসেছে। ফলে তারা তখন অবশ্যই ক্রিকেটের উল্লেখযোগ্য একটা দল। অথচ এখানে বলা হচ্ছে, তারা যেনো পিকনিক করতে গেছে। এটা একেবারেই বালখিল্য একটা ব্যাপার। ভারত ১৯৮৩ সালের কয়েক যুগ আগেই ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ন দল। তাদের দলে তখন সানি গাভাস্কার, কিরমানি, ভেঙসরকার, কপিলের মত লিজেন্ডরা খেলছেন। এরা প্রত্যেকে তখন ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত নাম। ভারতীয় দলের এক গণ্ডা খেলোয়াড় তখন নিয়ম করে কাউন্টি ক্রিকেট খেলে। মোটেও তারা আউটসাইডার নয়।
আর এই প্রসঙ্গে কিছু জায়গায় স্রেফ ছ্যাবলামো করেছেন পরিচালক।
ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েডদের দেখে ভারতীয় ক্রিকেটাররা চোখ বড় বড় করে তারকা দেখার মত ভঙ্গি করছে। কাছে গিয়ে বলছে, ‘বিগ ফ্যান, স্যার। বিগ ফ্যান।’
ভাবখানা এমন যে, এরা আগে কখনো এই ক্যারিবিয়দের দেখেনি।
আবার খেলোয়াড়রা দূর থেকে বলছে, ওই যে জোয়েল গার্নার; এভাবে বল করে। ওই যে রবার্টস; ওভাবে বল করে। তারা যেনো এদের এই প্রথম দেখছে। ভাই, দলটা ভারত; ইস্ট আফ্রিকা নয়।
এই ভারত আগের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে ৫ টেস্টের সিরিজ খেলে এসেছে। ২৫দিন তারা এই রিচার্ডস, গার্নার, লয়েডদের সাথে মাঠে কাটিয়েছে। দুই মাস তারা একসাথে হোটেলে থেকেছে। এরপরও তারা এরকম ন্যাকামো করবে? এটা কী ফাজলামো মনে হয়!
এই অতিনাটকীয়তা সিনেমাটার বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ করে দিয়েছে।
সবমিলিয়ে একটা কথা বলা যায়, ক্রিকেটীয় জায়গা থেকে এই ছবিটা ভারতকে খুবই ব্যর্থভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভারত স্রেফ ওয়ানডেটা তখন ভালো খেলতো না; এই কারণে তাদের ক্রিকেটের হনুলুলু বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা সত্যের অপলাপ। সেই সাথে ছবিতে নেই মন কাড়া কোনো গল্প।
ফলে এই ছবিকে তো পাশ মার্ক দিতে পারছি না।