২০১৪ সালের বিখ্যাত লা ডেসিমা জয়ের ম্যাচে গোল করে জার্সি উঁচিয়ে ধরা, এক দৌড়ে ভেঙে দেয়া জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখের রক্ষণভাগ, কিংবা মাঠের বাম প্রান্ত থেকে ট্রেডমার্ক ক্রস; মার্সেলো ভিয়েরা ডা সিলভা জুনিয়র – নামটির সাথে এমন কত কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
ঝাকড়া চুলের পাগলা চরিত্রের মার্সেলো ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অনন্য। তার খেলার সাথীরা যখন চেয়েছিল গোল করতে, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন গোল থামানোর। ব্রাজিলের বোতাফোগো সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে খেলার সাথীরা সবাই যখন পেলে, রিভালদো, গারিঞ্চা, রোনালদো হতে চাইলো তখন মার্সেলো বললেন কার্লোসের কথা; বিশ্ব ফুটবলের বুলেট মানব খ্যাত রবার্তো কার্লোস হতে চাইলেন তিনি।
রিও ডি জেনিরো’র পাশের ক্যাতেতে গ্রামে বেড়ে ওঠা মার্সেলো ভিয়েরা’র। আট-দশটা সাধারণ ব্রাজিলিয়ান পরিবারের মতো তার পরিবারেরও সঙ্গী ছিলো দারিদ্র্যতা। একইভাবে অধিকাংশ ব্রাজিলিয়ান কিশোরের মতই মার্সেলো’র প্রথম প্রেম হয় চামড়ার বলটার সাথে। ছোটবেলা থেকেই তাই সুযোগ পেলে মেতে উঠতেন ফুটবলের নেশায়।
দুইবারের চেষ্টায় ফ্লুমিনেন্সের যুব দলে জায়গা পান মার্সেলো। গতি, দক্ষতা আর খেলাটার প্রতি অভাবনীয় নিবেদনে নিজেকে আরো শানিত করে তোলেন তিনি। আর এমন উন্নতি নজরে আসেন ফ্লুমিনেন্সের শীর্ষ কর্তাদেরও। ফ্লুমিনেন্সের সিনিয়র দলে খেলার সুযোগ করে দেয়া হয় তাকে।
তখন অবশ্য মার্সেলো জানতেন না, বিধাতা কি রেখেছে তার জন্য। ২০০৬ সালের ১৪ নভেম্বর রিয়াল মাদ্রিদ প্রেসিডেন্ট র্যামোন ক্যালেদরন মার্সেলোকে হাজির করেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সফলতম ক্লাবটির ফ্যানদের সামনে। ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে জায়গা পাওয়া এমনিতেই অনেক বড় ব্যাপার, কিন্তু মার্সেলোর জন্য এটি ছিলো আরো বিশেষ কিছু। কারণ রিয়াল মাদ্রিদেই খেলতেন তার আইডল রবার্তো কার্লোস। আর তাই হয়তো প্রথম দিন থেকে মাদ্রিদের শুভ্র সাদা জার্সির মায়ায় জড়িয়ে পড়েন মার্সেলো।
কিন্তু মাদ্রিদের জার্সি আপন করে নিতে পারেনি নবাগত তরুনকে। তাই শুরু থেকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় মার্সেলো ভিয়েরা’কে। মূল দলের সঙ্গে ট্রেনিং করার সুযোগ পেলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ দেয়া হতো না তাকে। মূলত ডিফেন্সিভ কলাকৌশলের ঘাটতির কারনেই মার্সেলো’কে খুব একটা দলে রাখতেন না কোচ’রা। তবু সাদা জার্সির মায়ায় সব বাধা টপকে গিয়েছেন মার্সেলো, ম্যাচ না খেললেও আইডল কার্লোস থেকে শিখেছেন যতটা সম্ভব। নিজেকে তৈরি করেছেন ঠিক সময়ের জন্য।
মাদ্রিদ সমর্থকেরা তার উপর সন্দেহ করলেও ভরসা রেখেছিলেন কার্লোস নিজে। তাই নিজ হাতেই গড়ে তুলেছেন স্বদেশী এই ফুলব্যাককে। পরিনত মার্সেলো ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের একাদশে। রবার্তো কার্লোসের বিদায়ের পর অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতে নিয়েছেন আরাধ্য লেফটব্যাক পজিশন।
শুরুর ঝড় ঝাপট সামলে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রিয় জার্সি আগলে রেখেছেন মার্সেলো। খেলেছেন সাড়ে পাঁচশো’র বেশি ম্যাচ। এ-সময়টাতে কত কত ক্লাবই তো টাকার বান্ডিল নিয়ে ঘুরেছিল তার পিছু, কিন্তু বারো নম্বর জার্সির ভালবাসার তুলনায় সেসব কিছু তুচ্ছ ছিল হয়তো।
অ্যাটাক এবং ডিফেন্স দুটোতেই দাপট দেখানো মার্সেলো ছিলেন লস ব্ল্যাঙ্কোস কোচদের এক অনবদ্য হাতিয়ার। বিশেষ করে বামপাশ থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র সঙ্গে মার্সেলো’র গড়া জুটি ছিল প্রতিপক্ষের এক সাক্ষাৎ ত্রাস। মার্সেলোর মাপা ক্রস আর পর্তুগিজ তারকা’র লাফিয়ে ওঠা হেড, মাদ্রিদিস্তাদের কত কত উদযাপনের উপলক্ষ এনে দিয়েছে তা হয়তো হিসেব করা যায় না।
নিজের গোল হোক কিংবা সতীর্থের; অল হোয়াইটদের প্রতিটি গোলে মার্সেলোর উদযাপনে ফুটে উঠে মাদ্রিদিজমের প্রতিচ্ছবি। মার্সেলো কি দিয়েছে সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো গোল কিংবা অ্যাসিস্টের সংখ্যায় দেয়া যাবে না। মার্সেলো তো দিয়েছেন ভক্তদের সম্মোহিত করে দেয়া কয়েকটি মুহূর্ত। ভয়াল সুন্দর ক্রস, গতিময় ড্রিবলিং আর সাম্বা জাদু দেখিয়ে কোটি কোটি চোখকে শীতল করেছেন মার্সেলো। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ের ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে মার্সেলোর গর্জন কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বুকে।
নিজের আইডল রবার্তো কার্লোসের বিশালতা ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন কিনা মার্সেলো সেটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে দল আর মত নির্বিশেষে সবাই মেনে নিবে মার্সেলো ভিয়েরা ফুটবলার হতে গিয়ে প্রেমিক হয়েছেন, রিয়াল মাদ্রিদের স্বার্থহীন প্রেমিক।
পৃথিবীর আবর্তনে ক্যালেন্ডারের পাতাও পুরোনো হয়ে যায়, ফুরিয়ে যাওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছে মার্সেলো’র পা জোড়া। ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় এসে পৌঁছেছেন তিনি। মাদ্রিদের আভিজাত্য রক্ষার যুদ্ধ শেষে বড্ড ক্লান্ত মার্সেলোর পুরোনো সেই গতিও কমে গিয়েছে। হয়তো আর কয়েকটা দিন বাকি, এরপরই বিদায় নেবেন মাদ্রিদের লোগো বুকে ধারণ করা মানুষটা।