বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেটপ্রেমীরা তাঁকে কোচ হিসেবেই চেনেন। জানেন ডাগ আউটে বসে দারুণ সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। অথচ কোচিং ক্যারিয়ারের প্রবেশের আগে তাঁর রয়েছে বর্ণিল এক ক্রিকেট জীবন। বিশ্বকাপ জিতেছেন, দুরন্ত ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি মিডিয়াম পেসটাও মন্দ করতেন না। তিনি টম মুডি, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার।
পার্থের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্ম মুডির। হেডমাস্টার বাবার কড়া শাসনে বেড়ে ওঠা। পড়ালেখায় ফাঁকি দেয়ার জো নেই, কিন্তু তাই বলে কি খেলাধুলা থেমে থাকবে। খাতা-কলমের পাশাপাশি খেলার মাঠেও সমান দুরন্ত মুডি। স্কুল দলের হয়ে ক্রিকেটের পাশাপাশি চুটিয়ে খেলেছেন হাইজাম্প এবং অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল।
তবে, ১৩ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের প্রশ্নে বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেটকেই। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে অভিষেক মুডির। প্রথম মৌসুমেই নিজের প্রতিভার জানান দেন তিনি। পাঁচ ম্যাচ খেলে সেবার প্রায় ৩৪ গড়ে সংগ্রহ করেন ৩০২ রান, যেখানে সর্বোচ্চ ছিল ৯৪ রানের ইনিংস। পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে বল হাতেও ছিলেন সমান সাবলীল।
ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ পারফর্মের সুবাদে খুলে যায় জাতীয় দলের দরজাও। ঢুকে পড়েন অ্যালান বোর্ডারের নেতৃত্বাধীন ১৯৮৭ বিশ্বকাপগামী দলে। কিন্তু সেখানে তিন ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পেলেও বলার মতো কিছুই করতে পারেননি। ফলে বিশ্বকাপ জিতলেও পরের সিরিজেই দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। সে সময়ের তারকাবহুল অজি দলে সুযোগ পাওয়া ছিল খুবই কঠিন ব্যাপার।
দলে মানিয়ে নেয়ার জন্য সময় পাওয়া যেত না কারণ তোমার পেছনে একটি মাত্র সুযোগের অপেক্ষায় মাথা কুটে মরছে অনেকে। মুডিরও তাই পুনরায় দলে ফিরে আসতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। তবে তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন, জানেন লেগে থাকলে ঠিকই একসময় ডাক পাবেন।
অবশেষে ফুরোয় অপেক্ষার প্রহর। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দলে নেয়া হয় তাঁকে। নিজের জন্মস্থল পার্থেই বুঝে পান নিজের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। অভিষেকে টেস্টেই বুঝিয়ে দেন এতদিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। তিন নম্বরে নেমে ৬১ রানের ইনিংসের পাশাপাশি ডেভিড বুনের সাথে গড়েন ১৪৯ রানের জুটি। লাল বলের ক্রিকেটে এমন দারুণ খেলার সুবাদে ডাক পেয়ে যান ওয়ানডে দলেও।
পরের বছরই পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে ওপেনিং এ নেমে খেলেন ৮২ বলে ৮৯ রানের ইনিংস। সমান চারটি করে চার এবং ছক্কা হাঁকানো সেই ইনিংসেই সুবাদে জয় পায় অস্ট্রেলিয়া আর তিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। বর্তমান সময়ের বিচারে অহরহ এই ধরনের ইনিংস দেখা গেলেও, সে সময়ের বিচারে এই ইনিংস ছিল অবিশ্বাস্য।
মুডি বিখ্যাত ছিলেন তাঁর মারমুখী ব্যাটিংয়ের জন্য। লম্বা-চওড়া হওয়ায় খুব সহজেই বল সীমানা ছাড়া করতে জানতেন। কাউন্টিতে একবার ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে ৩৬ বলে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। সেদিন এই বিধ্বংসী ছিলেন এই ব্যাটার, মাত্র ১১ মিনিটে ফিফটি এবং ২৬ মিনিটে তিন অংকে পৌঁছে যান তিনি।
ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে তাঁর করা এক মৌসুমে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এখনও ভাঙতে পারেনি কেউই। এছাড়া ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে মাত্র ২৮ বলে ফিফটি করেন, যা কিনা ছিল সেই সময়ের বিশ্বরেকর্ড। তবে ব্যাট হাতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৬ গড়ে ২১,০০০ রান এবং ৬৪ সেঞ্চুরি থাকার পরও লাল বলের ক্রিকেটে ক্যারিয়ার এগোয়নি মুডির।
মাত্র আট টেস্টেই শেষ হয়ে যায় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার। তবে সাদা বলের ক্রিকেটে বেশ বর্ণিল এক ক্যারিয়ার কাটান তিনি। ৭৬ ম্যাচে ১,২১১ রানের পাশাপাশি তুলে নেন ৫২ উইকেট। এছাড়া তিনবার বিশ্বকাপ খেলে দুইবার স্বাদ পেয়েছেন বিশ্বকাপ জয়ের।
তবে ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে ইনজুরিটা বেশ ভোগাচ্ছিল। পিঠের ইনজুরির কারণে ২০০১ সালেই বিদায় বলে দেন সব ধরনের ক্রিকেটকে। তবে ক্রিকেটার হিসেবে অবসর নিলেও মাঠে ফিরে আসেন কোচ হিসেব। খেলোয়াড়ি জীবনে নিজের তুখোড় বুদ্ধিমত্তা আর বিশ্লেষণী ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
এবার সেটা কাজে লাগান কোচ হিসেবে। শ্রীলংকা জাতীয় দলের কোচ ছিলেন বড় একটা সময়। তবে তাঁর বড় সাফল্য বোধহয় ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলোর হয়েই। কোচ হিসেবে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ এবং মুলতান সুলতান্সকে জিতিয়েছেন আইপিএল এবং পিএসএলের শিরোপা।
ধারণা করা হত, তাঁর সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থাকলে তিনিই হতেন সবচেয়ে বড় তারকা। নিজে টি-টোয়েন্টি খেলতে না পারার আক্ষেপ বোধহয় তিনি মেটাচ্ছেন কোচ হয়ে বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টিতে রাজত্ব করে।