জাস্টিন কেম্প, অঙ্কুরেই হারানো ‘নতুন ক্লুজনার’

জাস্টিন কেম্পের মাঝে প্রতিভা ছিল পূর্বসূরি ল্যান্স ক্লুজনারকে ছাড়িয়ে যাবার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার টিম ম্যানেজমেন্ট কখনোই কেম্পের পুরোটা পায়নি কিংবা তাঁকে ব্যবহার করতে পারেনি।

ল্যান্স ক্লুজনারের গোধূলি-বেলায় তাঁর আবির্ভাব। জুলুর মতোই ম্যাচ শেষ করে আসার ক্ষমতা আর বোলিংয়ে তাঁর চাইতেও ভালো- সব মিলিয়ে ক্লুজনারের উত্তরসূরি হয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে যাত্রা শুরু তাঁর। ছয় ফুটের উপর লম্বা, পেটানো শরীর, সুদর্শন চেহারার ভদ্রলোক, অথচ মাঠে নামলেই হয়ে যেতেন নির্দয়। ব্যাট হাতে বড় বড় ছক্কা হাঁকাতেন, আবার বল হাতে নাভিশ্বাস তুলে ফেলতেন প্রতিপক্ষের বোলারদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্যারিয়ারটা যেন থমকে গিয়েছে কোথাও গিয়ে। তিনি জাস্টিন কেম্প, দক্ষিণ আফ্রিকার এক আজন্ম আক্ষেপ।

জাস্টিন কেম্পের বেড়ে ওঠা ক্রিকেটপ্রেমী এক পরিবারে। তাঁর দাদা এবং বাবা ছিলেন আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিচিত মুখ। তাঁর এক কাজিন দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের খেলেছিলেন এক ম্যাচ। ঘরোয়া ক্রিকেটে ইস্টার্ন প্রভিন্সের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করেই নিজের জানান দিয়েছিলেন কেম্প। টেস্ট অভিষেকের এক মাস পরেই খেলেন ১৮৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস।

নয়টি ছয় দিয়ে সাজানো তাঁর সেই ইনিংসের পাঁচটি ছয় তিনি হাঁকিয়েছিলেন এক ওভারেই। এর আগের মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতে না পারলেও, ঠিকই বল হাতে তুলে নেন পাঁচ উইকেট। তাঁর দারুণ পারফরম্যান্সের সুবাদেই দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ জিতে নেয় ইনিংস এবং সাত রানের বড় ব্যবধানে। 

তবে অভিষেকের কয়েক মাস বাদেই নিজের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন কেম্প। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ জয়ের পর মাঠের বাইরে উদযাপন করছিলেন আফ্রিকার খেলোয়াড়রা। কিন্তু সেবার উদযাপনের মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, কয়েকজন খেলোয়াড়ের বিপক্ষে নিষিদ্ধ মারিজুয়ানা সেবনের অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্তদের মাঝে ছিলেন কেম্পও। তবে সেই বছরই ডারবানে ভারতের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগারের দেখা পান তিনি, ২০ রানে নেন তিন উইকেট।

রাহুল দ্রাবিড়, যুবরাজ সিং, অনিল কুম্বলকে আউট করে দলকে শিরোপা জেতাতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এই সময়টাতে কেম্প ব্যাটিং এর তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত ফিনিশার হিসেবে ব্যাট করলেও জাতীয় দলে তার ভূমিকা ছিল কেবল বোলার হিসেবেই। 

২০০২ সালের দিকে বাজে ফর্মের কারণে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর কাউন্টি খেলতে চলে যান কেম্প। সেখানে ওরচেস্টারশায়ারের হয়ে গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে একই ম্যাচে ৪৮ রানে পাঁচ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৯০ রান করে জানান দেন নিজের প্রতিভার। ফলশ্রুতিতে নির্বাচকরা খুব বেশিদিন তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেননি, ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে পুনরায় দলে ডাক পান তিনি। সেই সিরিজের প্রথমবারের ব্যাট হাতে কেম্পের দক্ষতার নিদর্শন পায় বিশ্ববাসী।

মহাগুরুত্বপূর্ণ পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ম্যাচে ব্যাট হাতে দলকে জেতান একা হাতে। পঞ্চম ম্যাচে হার্শেল গিবসের সাথে ১৪৭ রানের জুটি গড়ার পথে খেলেন ৩৬ বলে ৫৭ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। সমান চারটি করে চার এবং ছক্কা হাঁকানো তাঁর সেই ইনিংসের সুবাদেই ২৯১ রানের সংগ্রহ পায় প্রোটিয়ারা।

পরের ম্যাচেই তাঁর ৫০ বলে ৮০ রানের ইনিংসের সুবাদে তিনশো ছাড়ানো সংগ্রহ পায় গ্রায়েম স্মিথের দল। এই সিরিজের পারফরম্যান্সের পর তাঁর ব্যাটিং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবতে বাধ্য হয় টিম ম্যানেজমেন্ট। 

পারফরম্যান্সের এই ধারাবাহিকতা তিনি ধরে রাখেন পরের সিরিজেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেলেন ২১ বলে ৫৩ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। সেদিন ব্যাট হাতে রীতিমতো অতিমানব হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে সাত নম্বরে দলের জন্য ভরসার পাত্র হয়ে ওঠেন তিনি। নিয়মিতই খেলতে থাকেন ধ্বংসাত্মক সব ইনিংস। তবে প্রায়ই ফিফটির দেখা পেলেও কেন যেন সেঞ্চুরি পাচ্ছিলেন না কেম্প। কাছাকাছি গেলেও বারবারই ফিরে আসতে হচ্ছিল হাত ছোঁয়া দূরত্বে থেকে। অবশেষে ভারতের বিপক্ষে নিজের সেঞ্চুরির গেঁড়ো কাটান কেম্প।

সেদিন ৭৬ রানেই ছয় উইকেট হারিয়ে মহাবিপদে পড়ে যাওয়া আফ্রিকাকে খাঁদের কিনারা থেকে টেনে তুলেন তিনি। প্রথমে শন পোলককে নিয়ে গড়েন ৬০ রানের জুটি। দলীয় ১৩৬ রানের মাথায় পোলক আউট হবার পর যেন আরও ধ্বংসাত্নক হয়ে ওঠেন তিনি, ভারতীয় বোলারদেরকে পাড়ার বোলারে নামিয়ে এনে অ্যান্ড্রু হলকে সাথে নিয়ে গড়েন ৮৫ বলে ১৩৮ রানের জুটি। নিজের সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি দলকে এনে দেন ২৭৪ রানের নিরাপদ সংগ্রহ। পরবর্তীতে  সেদিনের বোলিংনির্ভর পিচে দলকে জেতাতে কোনো সমস্যাই হয়নি আফ্রিকার বোলারদের, ভারত অল আউট হয়ে যায় ১৬৮ রানেই। 

কিন্তু এরপরই ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেন কেম্প। অর্থের লোভে যোগ দেন ভারতোয় নিষিদ্ধ ক্রিকেট লিগ আইসিএলে, চুক্তিবদ্ধ হন হায়দ্রাবাদ হিরোসের সাথে। ফলশ্রুতিতে কার্যত সেখানেই শেষ হয়ে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে চুক্তি বাতিল করলেও জাতীয় দলে আর ডাক পাননি। তবে ২০১০ আইপিএলে সুযোগ পেয়েছিলেন চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে।

দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ৮৫ একদিনের ম্যাচে অংশ নিয়ে ৩১.৫০ গড়ে সংগ্রহ করেন ১,৫১২ রান। পাশাপাশি বল হাতে তুলে নেন ৩২ উইকেট। সাদা বলের ক্রিকেটের পারফরম্যান্সটা তিনি টেনে নিতে পারেননি লাল বলের ক্রিকেটে। ফলত মাত্র চার টেস্টেই শেষ হয় তাঁর ক্যারিয়ার। তবে পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, কেম্পকে বিবেচনা করতে হবে তাঁর বিধ্বংসী ব্যাটিং দিয়ে। 

জাস্টিন কেম্পের মাঝে প্রতিভা ছিল পূর্বসূরি ল্যান্স ক্লুজনারকে ছাড়িয়ে যাবার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার টিম ম্যানেজমেন্ট কখনোই কেম্পের পুরোটা পায়নি কিংবা তাঁকে ব্যবহার করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে অল্পতেই ফুরিয়ে গিয়েছেন আফ্রিকার ‘নতুন ক্লুজনার’।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...