বাঙালি ও ভারতীয়দের ২০০৭ বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছিলো মাস খানেক আগেই। চার বছর আগের সেই অভিশপ্ত ২৩ মার্চের সন্ধ্যেটাই যেন ২০০৭ এও ফিরে এসেছিলো ততোধিক অভিশপ্ত রাত হয়ে। কাজেই ২৮ এপ্রিল গিলক্রিস্টের সেই নৈশ তাণ্ডব প্রতক্ষ্য করা থেকে হয়তো অনেকেই বিরত ছিলেন। কিন্তু যাঁরা বিরত ছিলেন, তাঁরা যে কি জিনিস হারিয়েছেন ! পরে নিশ্চয় আফসোস হয়েছে।
একটা লম্বা ছুটির উইকেন্ড শুধুমাত্র ল্যাধ খেয়ে ঝড়ের মতো কেটে গেলে, পরদিন সকালে আপিস যাবার আগে যেরকম আফসোস হয়, হয়তো খানিক সেরকম। কষ্টটা বোঝা কঠিন নয়। কারণ আমি নিজেও যে তার ভাগিদার। একে বৃষ্টির কারণে খানিক থমকে থমকে চলা। দেরিতে শুরু। তায় ক্লাস সিক্সের ছেলের তখনও রাত জাগার অভ্যাস বড়োই কম। তা সেই দুঃখেই বিয়ারের স্বাদ ব্রিজারে মেটাতে পুরো ম্যাচটা সেদিন আরেকবার দেখছিলাম। একেবারে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন সহযোগে। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই লোকটা ২০০৭ সালে ওই ব্যাটিং কিভাবে করতে পারলেন?
এমনিতে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রায় শেষ অব্দি বিশ্বের মানচিত্রের একেবারে দক্ষিণ পূর্ব কোনে অবস্থিত দেশটিরই বিশ্ব পর্যায়ের ট্রফি গুলোর ওপর এক প্রকার মনোপলি ছিল। তাই ২০০৭ বিশ্বকাপ পন্টিংয়ের দল জিতছে, এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই। যেটা আশ্চর্য্যের, তা হলো, গোটা টুর্নামেন্টে মোটামুটি খেলতে থাকা একটি লোক বিশ্বকাপ ফাইনাল এলেই কিভাবে নিজের খেলাকে সাধারণত্বের মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে, অলৌকিকতার মহাকাশে উত্তীর্ণ করেন।
তবে কাপ ফাইনালের শাহরুখ যদি গিলি হয়ে থাকেন, কাজল নি:সন্দেহে তাঁর সেই স্কোয়াশ বল। সেইসময় গিলক্রিস্ট একটা সমস্যায় ভুগছিলেন। বটম হ্যান্ডে ব্যাটটা অত্যধিক চেপে ধরছিলেন। ফলে বড়ো শট নেবার সময় মাঝে মধ্যেই বেশি বটম হ্যান্ডের প্রয়োগে, শটের টাইমিং ঠিকঠাক থাকছিল না। ফলে, পার্থের এক কোচের কথায় গিলক্রিস্ট বাঁ হাতের গ্লাভসের নিচে স্কোয়াশ বল রাখা শুরু করেন। যাতে শেষ দুটো আঙ্গুল দিয়ে তাঁর বাঁ হাত ব্যাট গ্রিপ না করতে পারে। খানিক হালকা থাকে বটম হ্যান্ড। এই টোটকায় গিলক্রিস্ট তাঁর শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ রাঙিয়ে দিয়ে যান।
২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালটা ছিল গিলক্রিস্টের রাজতন্ত্রের । মাহেলা, মুরলির শ্রীলংকা সেখানে নিতান্ত সাধারণ প্রজা। কিন্তু শ্রীলংকা একটু অন্যরকম ভাবলে ব্যাপারটা তা নাও হতে পারতো। সেদিন খুঁটিয়ে খেলাটা দেখতে দেখতে অন্তত তাই মনে হলো। সেগুলোই একটু বলার চেষ্টা করি। প্রথমত, আক্রমণে মুরলিকে আনতে দেরি করে ফেলা।
দশ ওভার শেষ হবার পর সেদিন মুরলিকে আক্রমণে আনেন মাহেলা। হয়তো এই ভয়ে যে তিরিশ গজ বৃত্তের বাইরে মাত্র দুই ফিল্ডার নিয়ে কেনসিংটন ওভালের ছোট মাঠে মুরলি মার খেয়ে যাবেন। মিসহিটেও চার ছয় মেরে দেবেন হেডেন-গিলক্রিস্ট। কিন্তু হাজার হলেও তিনি তো মুরলি। গিলক্রিস্ট সেট হয়ে যাবার পরেও তাঁর দুসরা ‘পিক’ করতে বেগ পাচ্ছিলেন। ইনিংসের শুরুতে পেস খেলবেন না স্পিন, গিলক্রিস্টকে জিজ্ঞেস করলে হলপ করে বলতে পারি, তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন পেস। সেখানে শুরুতে মুরলিকে নিয়ে আসা ছিল যাকে ইংরেজিতে বলে, ‘রিস্ক ওয়ার্থ টেকিং’।
দ্বিতীয়ত, অরবিন্দ ডি সিলভার মতো একজন কুশলী স্পিনার না থাকা। ২০০৩ এর সেমিফাইনালে তিনি গিলক্রিস্টের উইকেট পেয়েছিলেন বলে নয়, অরবিন্দ ডি সিলভার মতো ক্ষুরধার পার্ট-টাইম বোলার ওয়ানডে ক্রিকেটে কমই এসেছে। ডি সিলভার বদলে আর্নল্ডকেও চেষ্টা করা যেত। কিন্তু মাহেলা করেননি। আর সনাথ জয়াসুরিয়া যেহেতু বাঁ হাতি স্পিনার, কাজেই তাঁর বলগুলো একেবারে গিলক্রিস্টের ‘হিটিং আর্কে’ আসবে।
এমতাবস্থায়, শ্রীলংকা ফাইনালে দ্বিতীয় স্পিনার হিসাবে মালিঙ্গা বান্দরাকে ভাবতে পারতো। বান্দরা যেমনই বোলার হন, হাজার হোক স্পিনার। বল পড়ে ব্যাটে খানিক ধীর গতিতে আসলে, অস্ট্রেলিয়ানরা একটু হলেও বেগ পেতেন। সম্ভবত কেনসিংটন ওভালের সাইজ ও দিলহারা ফের্নান্দোর ফর্মের কথা ভেবে মালিঙ্গা বান্দরাকে ভাবা হয়নি। কিন্তু এখানেও সেই ‘রিস্ক ওয়ার্থ টেকিং’-এর গল্প এসে যায়। বাকিটা পার্থের বাঁহাতি ‘বুঝে নিয়েছিলেন’।
২০০৭ এর বিশ্বকাপ এমনিতে ভারতীয়দের কাছে সেরকম সুখস্মৃতি নয়। একে ভারতের আগেভাগে বিদায় নেওয়া। তায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিদঘুটে সময়। সাথে উলমারের মৃত্যু, ম্যাড়ম্যাড়ে মাঠ, ততোধিক কম দর্শক, বৃষ্টি। বিশ্বকাপের ফাইনালটাও একইরকম। বারবার বৃষ্টি, একপ্রকার প্রথমার্ধেই ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়া, মাঠের পরিকাঠামোগত অব্যবস্থা, স্কোর নিয়ে শোরগোল-আর কতো বলবো। তবু এতো অন্ধকারের মধ্যেই গিলক্রিস্টের ১০৪ বলে ১৪৯ রয়ে গেছে ক্যারিবিয়ান বিশ্বকাপের অবিনশ্বর আলোর মশাল হয়ে।