১.
সাল ২০০০, ডানেডিনে অজস্র দর্শকের মাঝে খেলা চলছে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের। নিউজিল্যান্ডের তখন ৬৫ বলে লাগে ৮৮ রান। উইকেটে অ্যাডাম প্যারোরে, বল করতে ছুটে আসছেন ব্রেট লি!
ডানেডিনের গ্যালারিতে অ্যাডিডাসের ট্রাকস্যুট গায়ে সস্ত্রীক বসে আছেন ইলিয়ড বেল (ছদ্মনাম)। দুর্দান্ত কিউই সাপোর্টার হিসেবে ব্লাকক্যাপসদের কোন ম্যাচই তিনি মিস দেন না। আজকেও দেন নি। এমনিতে তাঁর দেশে ক্রিকেটটা এত জনপ্রিয় নয়, কিন্তু তিনি খেলাটাকে ভালবাসেন তাঁর দেশের অন্যান্য মানুষের চাইতে ঢের ঢের বেশি।
ব্রেট লি বল করতে ছুটে আসছেন, বেল গ্যালারি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। অ্যাডাম প্যারোরের উপরে তাঁর আস্থা আছে, সেই আস্থার কিছুটা প্রতিফলন দেখতে চান তিনি। কিন্তু ব্রেট লি-র এক বাউন্সার সোজা গিয়ে আঘাত হানল প্যারোরের হেলমেটে। মুখে হাত দিয়ে ফেলেছেন বেল, ততক্ষণে প্রিয় ক্রিকেটারের হেলমেট মাথা থেকে সরে গিয়ে শূন্যে পড়ে গেছে, আর এরপর আচমকা তা আঘাত হানল সোজা স্ট্যাম্পে!
আউট? নাকি নো বল? মাঠের আম্পায়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন আউট। নিউজিল্যান্ডের জয়ের আশার বাতিঘর হিসেবে ক্রিজে থাকা অ্যাডাম প্যারোরে ফিরে যাচ্ছেন প্যাভিলিয়নে। গ্যালারিতে হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল বেলের। স্পষ্ট জানেন তিনি, এটা নো বল। আর এখানে কিনা আম্পায়ার হিট উইকেটের আউট ঘোষণা করে দিলেন। রাগে গজগজ করতে করতে অনবরত গালি ছুঁড়ে দিচ্ছেন তিনি শূন্যে কারো উদ্দেশ্যে। রীতিমত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন তিনি।
বেলের সাথে খেলা দেখতে এসেছেন তাঁর স্ত্রী রোজ( ছদ্মনাম)। তিনি হাত টেনে স্বামীকে বসিয়ে দিলেন সিটে। ম্যাচের এখনও অনেকটা বাকি, তাই শান্ত হতে বললেন। তবে বেল এখনও রাগে গজগজ করছেন, আস্তে আস্তে হারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিউজিল্যান্ড, মানতে পারছেন না বেল!
অস্ট্রেলিয়া ৩০ রানে ম্যাচ জিতে গেছে। ম্যাচের মাঝে কিছুটা শান্ত হলেও আবারও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন বেল। ম্যাচ শেষ হয়েছে, গ্যালারি ছেড়ে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে যেতে হবে এখন। সিট ছেড়ে ওঠার সময় একবার মাঠে থাকা ম্যাথ্যু হেইডেনকে দেখে নিলেন, মাঠে আম্পায়ারের সাথে বাকবিতন্ডা করে এই হেইডেনই বেশি দাবি করেছেন এটা আউট ছিল। হেইডেনকে একবার পেলে হয়, বাপের নাম ভুলিয়ে দেওয়া যেত!
ডানেডিনের স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে বেল আর রোজ দুজনই টের পেলেন, তাদের ভীষণ ক্ষুধা লেগে গেছে। আশেপাশে মানুষের ভিড়, রাতও হয়ে গেছে অনেক। আস্তে আস্তে ঘরে ফিরছে মানুষ, নিউজিল্যান্ড হেরে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষেরই বেজার মুখ। দ্রুতপায়ে হেঁটে পাতলা ভিড়ের মাঝে এসে বেলকে জিজ্ঞেস করলেন রোজ, “ম্যাকডোনাল্ডে গেলে হয়না?”
প্রস্তাবটা ফেলে দেবার মত নয়। পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ দেখেই ক্ষিধেটা লেগেছিল, মাঝের রাগটা সেই ক্ষুধাকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। তবে এখনও হেইডেন আর ব্রেট লি কে ভুলতে পারছেন না বেল। উচিত শিক্ষা দেওয়ার একটা সুপ্ত ইচ্ছেয় গজগজ করছেন তিনি। রোজ অবশ্য বারকয়েক স্বামীকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, তাতে কাজ হয়নি। তবে রোজের দেওয়া ম্যাকডোনাল্ডের প্রস্তাবটা খারাপ না, ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন বেল, ‘চলো যাই’
২.
ক্ষুধাটা শুধু বেল আর রোজেরই লাগেনি, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদেরও লেগেছে। একটা ক্রিকেট ম্যাচ খেলা কি কম খাটুনির কাজ? তাছাড়া ম্যাচটা জিতে একটু ফুরফুরেও লাগছে, হোটেলে তাই মন টিকছে না হেইডেনের। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখতে দেখতে তিনি ভাবলেন, একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলে কেমন হয়?
হেইডেনের ভাবনাটা কিছুক্ষণ পর আর শুধু ভাবনা হিসেবেই রইল না। দেখা গেল, হেইডেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের একটা দল নিয়ে ভ্যানে করে বেরিয়ে পড়ছেন একটু ঘুরবেন বলে। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পর, দূরে ম্যাকডোনাল্ডের একটা রেস্টুরেন্ট দেখা গেল। এখানে একটু খাওয়াদাওয়া করলে কেমন হয়?
সম্মতির আশায় হেইডেন প্রস্তাবটা তুললেন তাঁর সাথে আসা টিমমেটদের মধ্যে। কেউ আপত্তি করল না। কিন্তু এদেশে তাঁরা অতিথি, হুট করে ঢুকে পড়াটা ভাল ব্যাপার হবেনা। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের মধ্যে যদি লোক অনেক বেশি হয়, তাহলে বিপাকে পড়তে হবে। রিফ্রেশমেন্টের জন্যে বের হয়েছে তাঁরা, উলটো ভিড়ের মধ্যে পড়তে হবে। হেইডেন তাই একজনকে ভেতরে পাঠালেন ভেতরে কি অবস্থা দেখে আসার জন্যে।
৩.
ম্যাকডোনাল্ডে এসে বসেছেন রোজ আর বেল। ওয়েটার এসে খাবারের অর্ডারও নিয়ে গেছেন। কিন্তু মাথা থেকে এখনও নিউজিল্যান্ডের হার দূর করতে পারছেন না বেল। রোজের সামনে আবার তুললেন সেই কথা, “নিশ্চিত নো বল ছিল, আর আম্পায়ার কিনা আউট দিয়ে দিল”
ইতোমধ্যে বারকয়েক বেলকে বুঝিয়েছেন রোজ। এবার তাঁর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তিনি কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয়েই বলে দিলেন, ‘তো তুমি আম্পায়ার থেকে বেশি বুঝো মনে হচ্ছে?’
বেল এমনিতেই রেগে ছিলেন, রোজের এই কথাতে একেবারে আগুনের কড়াই হয়ে গেলেন। আরো দুয়েক কথা চলার পর রোজও ক্ষেপে উঠলেন। ম্যাকডোনাল্ডের রাতের শান্ত আবহ মুখরিত হয়ে উঠল এক যুগলের কথা কাটাকাটিতে।
ম্যাকডোনাল্ডের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন হেইডেনের পাঠানো সেই ক্রিকেটার। দরজায় হাত রেখে ভিতরে সবে এক পা দিয়েছেন তিনি। হঠাৎ শুনতে পেলেন ভেতর থেকে পুরুষালি এক কণ্ঠ ভরাট গলায় বলছে, ‘হাতের কাছে পেলে ক্রিকেটের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দিতাম।’ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে দুয়েকটা গালিও ছুঁড়ে দিচ্ছে সে কথার মাঝে। ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেলেন ঐ ক্রিকেটার। দ্রুত ফিরে এলেন ভ্যানে।
ভ্যানে ফিরে এসে হেইডেনকে যা শুনেছে সবটা বললেন সেই ক্রিকেটার। বুদ্ধিমান হেইডেন বুঝতে পারলেন, আবহাওয়া আপাতত তাঁদের পক্ষে নেই। দ্রুত সিদ্ধান্তে তিনি হোটেলে ফেরার তাগাদা দিলেন সবাইকে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ঝাঁক বহনকারী সেই ভ্যান ইঞ্জিনের শব্দ তুলে ম্যাকডোনাল্ড ছেড়ে রওনা হয়ে গেল টিম হোটেলের উদ্দেশ্যে।
জানালা দিয়ে তা চোখ এড়ায়নি বেলের!
৪.
পরদিন সকাল। খুব সকালে উঠে বেলকনিতে দাঁড়িয়েই হোটেলের সামনে জটলা দেখতে পেলেন হেইডেন। জটলার কোলাহল থেকে বার কয়েক ‘হেইডেন’ শব্দটা কানে এল তাঁর। ঘুম ঘুম ভাবটা নিমেষেই চোখ থেকে উধাও হয়ে গেল তাঁর। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলেন তিনি।
হেইডেনকে নিচে নামতে দেখে উপস্থিত সবাই জায়গা করে দিল। ব্রেট লি এগিয়ে এসে হেইডেনকে নিয়ে গেল গাড়ির কাছে। গাড়ির কাছে যেতে যেতে ভিড়ের মাঝে আরো কিছু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারকে চোখে পড়ল হেইডেনের। চকিত একটা প্রশ্ন উঁকি দিল হেইডেনের মনে, এখানে কী হচ্ছে?
গাড়ির কাছে পৌছে হেইডেন দেখলেন, কাল রাতে যে ভ্যানে করে তাঁরা বেরিয়েছিলেন তার টায়ার কে জানি ব্লেড দিয়ে কেটে রেখে গেছে। সেই ব্লেডের সাথে একটা কাগজে আটকানো নোটও আছে। সেই নোটটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলেন হেইডেন, সেখানে লেখা – ‘হেইডেন, ইউর ফ্যামিলি উইল সাফার’। নোটের আরেকটু নিচে একটা স্বাক্ষরও চোখ এড়াল না হেইডেনের। তবে সেটাকে ঠিক স্বাক্ষর বলা যায় বলে মনে হয়না। যা হোক, সেখানে লেখা – ‘অ্যাডিডাস, থ্রি স্ট্রাইপস’!
নিউজিল্যান্ডে এমনিতে ঝুট ঝামেলা খুব কম। সেখানকার পুলিশেরা তাই বেশিরভাগ সময় বেশ আরামেই কাটায়। তবে এখনকার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। নিউজিল্যান্ড সফররত অস্ট্রেলিয়ার এক ক্রিকেটারকে কে যেন হুমকি দিয়ে একটা নোট রেখে গেছে। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড তো বটেই, ক্রীড়ামন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত অপরাধীকে খুঁজে বের করার তাগাদা দেওয়া হয়েছে! নিউজিল্যান্ড পুলিশের একটা দল ইতোমধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে।
৫.
অ্যাডিডাসের তিনটে স্ট্রিপ স্বাক্ষর করা অপরাধীকে খুঁজে পেতে নিউজিল্যান্ড পুলিশের খুব বেশি বেগ পেতে হল না। খুব সহজেই তাঁরা বেলকে খুঁজে বের করল। সে রাতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের ভ্যানটা দেখার পর বেল সোজা বেরিয়ে গেছিলেন রেস্টুরেন্ট থেকে, রোজও তখন বেলকে থামাতে পারেননি। তবে মজার ব্যাপার হল, বেলকে যখন নিউজিল্যান্ডের পুলিশ খুঁজে বের করেছে তখনও তাঁর গায়ে রয়েছে অ্যাডিডাসের সেই ট্রাকশ্যুট!
__________________
এই ঘটনাটা আমি শুনেছিলাম অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস আর অ্যডাম গিলক্রিস্টের মুখে, বিগ ব্যাশের এক ম্যাচ চলাকালীন ফক্স স্পোর্টসের কমেন্ট্রিতে। সে হিসেবে এটা সত্যি কাহিনী। কিন্তু আমি যেটা করেছি, এই সত্যি কাহিনী নিয়ে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। গল্প লিখতে গিয়ে কিছু অতিরিক্ত দৃশ্যেরও আশ্রয় নিতে হয়েছে। এটাকে তাই কোন ফিচার ভাবলে ভুল হবে। এটা স্রেফ সত্যি কাহিনীর ওপর নির্ভর করে লেখা ছোটগল্প।