ওলন্দাজদের একটা প্রবাদ আছে, ‘ঈশ্বর পৃথিবী নির্মাণ করতে পারেন কিন্তু হল্যান্ড নির্মাণ করেছে ডাচরা।’ থাকবে নাই বা কেন, বর্তমান নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডের দুই তৃতীয়াংশ স্থলভাগের তো ৮০০ বছর আগেও কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে, বালি এবং মাটি দিয়ে ব্যাকওয়াটার বুজিয়ে আজকের হল্যান্ড তৈরি হয়েছে। তাই শূন্য থেকে অট্টালিকা নির্মাণ ওলন্দাজদের মজ্জাগত।
অ্যামস্টারডামের আয়াক্সকেই দেখুন। সেই সত্তরের দশকের শুরুতে, রাইনাস মিশেলের আয়াক্স, ক্রুইফ, নিস্কেন্স, ক্রল, আরি হান মিলে টোটাল ফুটবলের জন্ম দিল। যা পঞ্চাশ বছর ধরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে যুগান্তকারী কোচদের ট্যাকটিক্সে ফিরে ফিরে আসছে।
তাই এই আয়াক্স প্রায় দশ বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট পর্বেই যেতে পারছিল না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এরিক টেন হ্যাগের আমলে।
এরিক টেন হ্যাগ খেলোয়াড় হিসাবে খুব নাম করেননি। সেন্টার ব্যাক হিসাবে ছোটোখাটো ক্লাবে খেলেছেন। কোচ হিসাবেও পাঁচ-ছয় বছর এদিক ওদিক ঘুরে আসেন আয়াক্সে, ২০১৭য়। এবং পরের সিজনেই একুশ বছরে প্রথমবার আয়াক্স চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমি ফাইনাল খেলে। গ্রুপ লিগে যদিও বা দ্বিতীয় হয়েছিল, কিন্তু শক্তিশালী বায়ার্ন মিউনিখ হোম বা অ্যাওয়ে ম্যাচে হারাতে পারেনি আয়াক্সকে।
এরপর প্রিকোয়ার্টারে গত তিনবারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ এবং কোয়ার্টারে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জুভেন্তাসকে জমি ধরিয়ে সেমি ফাইনালে টটেনহ্যাম হটসপারের কাছে শেষ মুহূর্তের গোলে অ্যাওয়ে গোল নিয়মে বিদায় নেয়। উঠতি প্রতিভাবানদের নিয়ে বানানো আয়াক্স দল, সেবার সকলকে চমকে দিয়েছিল। কিন্তু যা হয় আর কি! আধুনিক ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের তথাকথিত কুলীন দল না হওয়ায় আয়াক্স বড়দলগুলোর সাপ্লাই লাইন হিসাবেই কাজ করল।
ফ্র্যাঙ্কি ডে ইয়ং, ম্যাথিয়াস ডে লিট, ফন ডে বিক, হাকিম জিয়াক প্রথম সারির দলগুলিতে চলে গেল। অন্য যে কোন দলের মেরুদণ্ড খসে পড়লে, তার উঠে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু এই আয়াক্স বা এরিক টেন হ্যাগ তো অন্য ধাতুতে গড়া। রেডিমেড খাবার শুধু গরম করে তাঁরা খাবেন না। রীতিমতো সাধ্যসাধনা করে, ম্যারিনেট করে, ফোড়ন দিয়ে, কষে, দম দিয়ে, ভাপিয়ে তবে খাবার টেবিলে নিয়ে আসেন। পদ্ধতিটা ভালোমতো রপ্ত, তাই বারবার করে ফেলতে পারেন। এ বছরে আয়াক্সের খেলা দেখলে বোঝা যাবে কী বলতে চাইছি।
কেমন ভাবে টেন হ্যাগ দল সাজান? দেখা যাক। এরিক টেন হ্যাগের ২০২১-২২এর আয়াক্স কিন্তু ২০১৮-১৯এরই প্রতিফলন। তবে এবারে উইং-এ অনেক বেশি প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকায় কিছুটা বেশিই ডানা মেলছে।
টেন হ্যাগের স্ট্র্যাটেজি সেই টোটাল ফুটবলেরই স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু একটু অন্যরকম। তিনি শুরু করেন ৪-৩-৩এ। কিন্তু ডিফেন্সিভ ফর্মেশনে ৪-৩-২-১ হয়ে যায় আর আক্রমণে ৪-২-৩-১। যেখানে দুই উইঙ্গার একটু নিচ থেকে অপারেট করে ট্রান্সফরমেশনে সাহায্য করার জন্য এবং প্রেসিং-এর জন্য। দুই উইং ব্যাক আবার সুযোগ বুঝে আক্রমণে উইং ধরে উঠলে উইঙ্গাররা ইনভার্টেড হয়ে ভিতরে কাট করে ঢোকেন।
তিনজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফর্মেশনের মেরুদণ্ড বেয়ে সংযোগ স্থাপন করেন। একটা কাঠামো থাকেই কিন্তু টেন হ্যাগের বর্তমান দলের মুখ্য অস্ত্র হল তাঁর দুই উইঙ্গার। ডান দিকে বামপন্থী ব্রাজিলীয় অ্যান্তনি এবং বাঁ দিক দিয়ে ডেভিড নেরেস। অবশ্য নেরেস না হলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দুসান টাডিচ রয়েইছেন। টাডিচ বা দুই উইং ব্যাক টাগ্লেফিকো এবং ব্লাইন্ড সেই ১৮-১৯ এর ভার্শন থেকেই টেন হ্যাগের সহায়। ব্লাইন্ড আবার প্রয়োজনে সেন্টার ব্যাক হিসাবেও খেলতে পারেন।
টেন হ্যাগের দল মাঠের শিরদাঁড়া বরাবর জমাট থাকে, দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বা এক আক্রমণত্মক মিডফিল্ডার কাঠামো নষ্ট করতে দেয় না। দুই উইঙ্গার ক্রমাগত নিচে নেমে বিপক্ষের আক্রমণের ডানা ছাঁটতে প্রেস করেন। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সোয়া ছ ফুটের স্ট্রাইকার সেবাস্তিয়ান হালার। হালার আইভরি কোস্টের। এবং আগামী বিশ্বকাপের অন্যতম বড় অনুপস্থিতি। বহুদিন পরে একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার বা নাম্বার নাইনকে দেখছি যে, বিপক্ষের গোলের দিকে পিছন করে ইনভার্টেড উইঙ্গারদের জায়গা করে দিতে যেমন সক্ষম তেমনই, আকাশে বা জমিতে শিকার ছিনিয়ে নিতেও সিদ্ধহস্ত।
এই দলে ডে লিটের ডিস্ট্রিবিউশন বা ডি ইয়ং-এর মাঝমাঠের মস্তানি না থাকলেও দুই উইং জুড়ে কেরদানী রয়েছে। গোল রক্ষক ক্যামেরুনের আন্দ্রে ওনানা ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হবার কারণে এক বছরের জন্য সাস্পেন্ড। কিন্তু টেন হ্যাগের তাতে মাথা ব্যথা নেই, ৩৮ বছর বয়স্ক ডাচ গোল রক্ষক রেমকো পাসভিরকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। ওনানা কাজ করতেন সুইপার গোলরক্ষক হিসাবে, ফলস্বরূপ আয়াক্সের দুই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার উপরে উঠে হাইপ্রেসে অংশ নিতে সক্ষম হতেন। পাসভির অতটা না হলেও নিজের কাজটা বেশ ভালোভাবেই করছেন।
ডিপ ডিফেন্সে ডাচ পের স্যুর আর আর্জেন্তিনীয় লিসান্দ্রো মার্তিনেজ, আক্রমণটা নিচ থেকে শুরু করেন। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসাবে ৬ নম্বরে জোড়া ফলা আলভারেজ এবং গ্রেভেনবার্ক আর উপরে প্রয়োজন মতো কখনও স্টিভেন বরঘুইস, ক্লাসেন বা টাডিচ।
টেন হ্যাগের দর্শন অনুযায়ী হাই প্রেসের পর দ্রুত ট্রানজিশন, সেখানে হালারকে সাহায্য করতে নিচ থেকে উঠে আসছেন আক্রমণত্মক মিডফিল্ডার বা দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আর উইং ধরে দুই ফুল ব্যাক এবং উইঙ্গাররা তো রয়েইছেন।
গতবারের থেকেও যেন এবারের আয়াক্সের এই ট্রানজিশনের মসৃণতা চোখ টানছে। আশা করছি ২০১৮-১৯এর মতোই এবারও আয়াক্স অনেককেই চমকে দেবে। ইতোমধ্যেই বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, স্পোর্টিং সিপি আর বেসিকটাস এবং ঘরোয়া ডার্বিতে পিএসভি আইন্ডহোভেন টের পেয়েছে। উচলের নক আউট স্টেজে আরও চমক নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে হাজির হবে টেন হ্যাগের আয়াক্সের সরবরাহ শৃঙ্খল। পরের বছর হয়তো এই হালার, অ্যান্তনিরা আরও নাম করা দলে চলে যাবেন। কিন্তু টেন হ্যাগের শৃঙ্খল এবং শৃঙ্খলায় বাধা পড়বে না।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক