ব্যাঙ্গালুরু, ৯ মার্চ ১৯৯৬। ৪১.৩ ওভার খেলে ভারত ২০০/৪ স্কোরে। তখন অজয় জাদেজা ক্রিজে এলেন। চাপের ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকার ৩১ করে আউট, যিনি ভালো খেলছিলেন সেই নভজ্যোৎ সিং সিধু ৯৩ করে আউট। চালিয়ে খেলতে গিয়ে আজহার ও যখন রশিদ লতিফের দুরন্ত ক্যাচে ধরা পড়ে ফিরে যাচ্ছেন, তখন আর সাড়ে আট ওভারে বিশেষ রান হবে বলে ভারতের সমর্থকরা ভাবেননি।
সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান গ্রুপ লিগে দুর্দান্ত খেলেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা যারা সব ম্যাচ জিতেছিল তাদের কাছে ছাড়া হারেনি। রান ও অনেক বেশি রেটে করছিল। দুই ওপেনার আনোয়ার আর সোহেল দারুণ ফর্মে ছিলেন। ভারত তুলনায় শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে আবার জিম্বাবুয়ের সাথে রীতিমত সমস্যায় পড়ে কোনোভাবে কাম্বলি, সিধুর পার্টনারশিপ ও সেই জাদেজার স্লগ ব্যাটিং এর কাঁধে চেপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল।
এবারে যেটা বলার, ৯৬ বিশ্বকাপের আগে ওয়ানডেতে ভারত পাকিস্তান ম্যাচ আর বর্তমানে এটিকে মোহনবাগান আর এস সি ইস্টবেঙ্গল এর খেলা ছিল সমার্থক। শেষ দশটি ওয়ানডে ম্যাচ এ রেকর্ড ছিল পাকিস্তানের পক্ষে ৮-১ (১ টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়)। শারজায় পাকিস্তান বলে বলে হারাতো ভারতকে। পাকিস্তানের পেস বোলিংয়ের সামনে ভারত জবাব খুঁজে পেত না।
জাভেদ মিয়াঁদাদের সেই ছক্কার পোস্ট এফেক্ট দশ বছর পরেও চলছে, যোগ হয়েছে আকিব জাভেদের হ্যাটট্রিক। ৯২ বিশ্বকাপে ভারত জিতলেও, সেটা একটা অঘটন ছিল, কেননা পাকিস্তান কাপটাই জিতে নিয়েছিল। এই অবস্থায়, ৪১.৩ ওভারে ২০০/৪ স্কোর ভারতীয় ক্রিকেট প্রেমীদের মনে যে আতঙ্কের সঞ্চার করেছিল, আমরা যারা খেলা দেখছিলাম সেদিন, তারাই জানি।
পরের ৪৯ বলে আরো ৪ উইকেট খুইয়ে ভারত তুললো আরো ৭৯ রান, যার মধ্যে অজয় জাদেজা করেছিলেন ২৫ বল খেলে ৪৫ রান, ৫০তম ওভারের চতুর্থ বলে আউট হবার আগে। ওয়াকার ইউনুসকে ঠেঙ্গিয়ে সেদিনের মত ওই পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাঁর গোটা ক্যারিয়ারে খুব কম ব্যাটারই পেরেছিলেন। অনেকে ২০০৩ বিশ্বকাপে শচীন টেন্ডুলকার আর বীরেন্দ্র শেবাগের কথা বলবেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে ১৯৯৬ এর ওয়াকার আর ২০০৩ এর ওয়াকার এক নন। ৯৬ তে তিনি পিকে, বলের গতি, সুইং, ইয়র্কার দেবার ক্ষমতা সবই অনেক বেশি।
শেষ অবধি ভারত প্রত্যাশার চেয়ে বেশ বেশি ২৮৭ রানের বিশাল স্কোর পৌঁছায়; আনোয়ার-আমিরের মারকাটারি শুরু সত্ত্বেও ৩৯ রানে পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারত সেদিন ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছায়। এর মধ্যে ভেঙ্কটেশ প্রসাদের সাথে আমির সোহেলের উপভোগ্য এপিসোডটি আশা করি সকলেরই মনে আছে। কিন্তু সেদিন জাদেজার ইনিংস না থাকলে হত না, আমিও জানি আপনারাও জানেন।
মিয়াদাদের ছক্কার এফেক্ট কি ছিল আমি দেখেছি, যদিও খেলাটা লাইভ দেখিনি। ৩৮ বছরের মিয়াঁদাদ যখন ৯৬ কোয়ার্টার ফাইনালে টেল এন্ডারদের নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, আস্কিং রেট অনেক হাই; আমরা জিতবো বলে লাফালাফি করছি; তখন বাবা কাকা জ্যাঠা দাদুরা মাথা নাড়ছেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। বলছেন – ‘ওই লোকটা যতক্ষণ আছে, বিশ্বাস নেই। ও সব পারে। শেষ বল অবধি বিশ্বাস নেই!’
আমরা নতুন প্রজন্ম বলছি – ‘আরে দাদু, আটের উপরে রান রেট লাগবে, অন্যদিকে, শুধু বোলার!’ তাতেও তাঁরা মাথা নাড়ছেন।
এই চেতন শর্মার শেষ বলে ছক্কার এফেক্ট অর্ধেক সেদিন কাটিয়েছিলেন জাদেজা। বাকি অর্ধেক ২০০৩ সালে সেঞ্চুরিয়ান এ থার্ডমানের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের ছোটবাবু। ওই দুটি ম্যাচ দেখে আমাদের থেকে আমাদের আগের জেনেরেশনের মানুষজন বোধ হয় অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন!
পরবর্তীকালে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে জড়িয়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় অজয় জাদেজার; নইলে হয়তো ২০০৫-০৬ অবধি চুটিয়ে খেলতে পারতেন তিনি। অজস্র দোষের উপাদান সরিয়ে রাখলেও ওই একটি ম্যাচের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট মনে রেখে দেবে তাঁকে।