প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ইতিহাসে কমপক্ষে দশ হাজার রান সংগ্রহকারী ব্যাটারদের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় তাঁর। তাঁর উপরে ৯৫.১৪ গড় নিয়ে আছেন শুধু স্যার ডন ব্রাডম্যান এবং ৭১.৬৪ গড় নিয়ে স্বদেশী বিজয় মার্চেন্ট।
অথচ, সেই অজয় শর্মাই কিনা ক্যারিয়ারে টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র একটি। আশি-নব্বই দশকের এ ক্রিকেটার যেন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম এক আক্ষেপের নাম হয়ে আছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেভাবে মেলে ধরতে না পারা অজয় শর্মা একটি টেস্টের পাশাপাশি ৩১ টি ওয়ানডে ম্যাচও খেলেছেন ৷ কিন্তু সুনীল গাভাস্কার থেকে শচীন যেভাবে বিশ্ব ক্রিকেটে কিংবদন্তি বনে গিয়েছেন, তার ধারের কাছেও যেতে পারেননি এ ক্রিকেটার।
ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর পরিচিতি রয়ে গিয়েছে একজন ঘরোয়া ক্রিকেট স্পেশালিস্ট হিসেবেই। অথচ রঞ্জি ট্রফিতে যেভাবে ব্যাট করতেন তাতে তাঁকেই আশি দশকের তারকা ভাবা হত। কিন্তু সেই ভাবনাটাকে পূর্ণতায় পরিণত করতে পারেননি সাবেক এ ক্রিকেটার।
রঞ্জি ট্রফিতে অজয় শর্মার ব্যাটিং গড় ছিল ৭৮.২৯! এমন দুর্দান্ত গড়ে একটা সময় ব্যাট করতেন ডন ব্র্যাডম্যান। আশি দশকের ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনে তাই অজয় শর্মার পরিচিতি বাড়তে থাকে ‘উপমহাদেশের ডন’ হিসেবে। বাস্তবিক অর্থেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করতেন এ ব্যাটার।
কথিত আছে, অজয় শর্মা নাকি ম্যাচের আগেই বলে দিতে তিনি সেঞ্চুরি করতে যাচ্ছেন। অবশ্য পরিসংখ্যানও যে সেটাই জানান দেয়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৬৬ ইনিংসে ৩৮ টা সেঞ্চুরি করেছেন আর ফিফটি ৩৬ টা। অর্থাৎ ফিফটির চেয়ে সেঞ্চুরিই বেশি!
এমন দুর্দান্ত পরিসংখ্যানের পর কেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্লান হয়ে রইলেন অজয় শর্মা? এমন প্রশ্নে আজও বিস্ময় জাগে। তবে ধারণা করা হয়, অজয় যখন রঞ্জি খেলতেন তখনও পুরোদস্তুর পেসার সেভাবে উঠে আসেনি ভারতীয় ক্রিকেটে।
ভারতের ক্রিকেট পাড়া ছিল রীতিমত স্পিন স্বর্গরাজ্য। অজয় শর্মা সেই স্পিনটাই ভাল খেলতে পারতেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে তাঁকে ক্যারিবিয়ানদের পেস সামলাতে হয়েছে। যেই অনভ্যস্ততাতেই তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বেশিদূর এগোয়নি।
যদিও ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্টে খুব খারাপ করেননি এ ব্যাটার। ১৯৮৮ সালের ১১ই জুন ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৩০ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ রান করেন। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫৩ রান। খারাপ নয়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরপরে আর নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পাননি অজয় শর্মা।
ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস রয়েছে সাবেক এ ক্রিকেটারের। তবে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস তিনি খেলেছিলেন ১৯৯৭ সালে রেলওয়ের বিপক্ষে। সে ম্যাচে ২৫৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন অজয়। তবে এই ইনিংসটি গুরুত্ববহ আরেকটি কারণে।
মূলত, রেলওয়ের বিপক্ষে সে ম্যাচটি হয়েছিল কর্নেল সিং স্টেডিয়ামে। আর এ ম্যাচের আগে একটি ভুল করে বসে পিচ কিউরেটররা। যে কোনো ম্যাচের আগেই পিচ রোল করা হয়। একই সাথে পানিও দেওয়া হয়।
কিন্তু, সে ম্যাচে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতেই ভুলে যায় কিউরেটরার। ফলশ্রুতিতে, এবড়ো থেবড়ো পিচে সুবিধা পেয়ে যায় স্পিনাররা। কিন্তু পিচ থেকে এমন সুবিধা পেয়েও সে ম্যাচে অজয় শর্মাকে পরাস্ত করতে পারেনি কোনো বোলার।
এরপর ২০০০ সালের দিকে অজয় শর্মার ক্রিকেট ক্যারিয়ার ভিন্ন দিকে মোড় নেয় নেতিবাচক এক ঘটনায়। সে সময় ভারতীয় ক্রিকেট পাড়া ফিক্সিং কাণ্ডে তোলপাড়। এমন সময়েই মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, অজয় জাদেজা, মনোজ প্রভাকরদের সাথে অজয় শর্মাও নিষিদ্ধ হন।
মনোজ প্রভাকর এবং অজয় জাদেজাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করলেও আজহারউদ্দীন এবং অজয় শর্মাকে দেওয়া হয় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আজীবনের নিষেধাজ্ঞা। ফলত, ৩৬ বছর বয়সেই থমকে যায় অজয় শর্মার ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
অজয়কে এরপর সেই ফিক্সিংয়ে কলঙ্ক বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়ে অনেকটা দিন পেরিয়ে অনেকটা বছর পর্যন্ত। দারুণ সামর্থ্যবান ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে মেলে ধরতে না পারার আক্ষেপ ছাপিয়ে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁকে কলঙ্ক মুছতেই ছুটতে হয়েছে আদালত পর্যন্ত। একটা সময় পর তিনি সেই কলঙ্ক থেকে মুক্তিও পান।
২০১৪ সালে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ থেকে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। দিল্লীর জেলা কোর্ট তাঁর উপর থেকে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তবে ততদিনে অজয় শর্মা যুবকদের দল থেকে বৃদ্ধদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন৷ অবশ্য বর্ণাঢ্যময় ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যে কালি তাঁর উপর পড়েছিল, সেটির অবসান ঘটে সে বছরেই। অজয় শর্মার তৃপ্ততা সেখানেই।
অবশ্য, ভারতীয় ক্রিকেটে ‘বড়’ নাম হওয়ার সব রসদ থাকা সত্ত্বেও সেটি না হতে পারার অতৃপ্ততা এখনও বোধহয় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অন্তত ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে তো তিনি আক্ষেপে ঘেরা এক চরিত্রের নাম।