ভুল সময়ে জন্ম। এই একটা বাক্য দিয়ে হয়ত অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে এই টি-টোয়েন্টির যুগে না দেখার আক্ষেপটাকে স্তিমিত করা যায়। একজন ‘কমপ্লিট ক্রিকেটার’ বলতে যা বোঝায় তাঁর পুরোটাই নিজের মধ্যে ধারণ করতেন সায়মন্ডস। আজকের এই মারকাটারি ক্রিকেটের জন্যে তিনি যেন ছিলেন আদর্শ।
অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস তাঁর সময়ের সেরা ফিল্ডারদের একজন ছিলেন। তাঁর সময় তো বটেই। চাইলেই এই সময়ের বাঘা-বাঘা ফিল্ডারদের সাথে তাঁর তুলনা করা যেতে পারে। তিনি যেন সত্যিকার অর্থেই ভবিষ্যৎ থেকে সে সময়ে যাওয়া কোন খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি তাঁর সময়ের থেকেও বড্ড বেশি এগিয়ে ছিলেন। সে প্রমাণ হিসেবে তাঁর ফিল্ডিং দক্ষতা হতে পারে অনন্য এক উদাহরণ।
তিনি ৩০ গজ সার্কেলের ভেতর ছিলেন বাজপাখি। তাঁর হাতের আশপাশ দিয়ে বল সে বৃত্ত পেরিয়ে যাবে তা যেন ছিল রীতিমত অসম্ভব। আর তাঁর শরীরি ভাষায় বরাবরই একটা ইতিবাচকতার ছাপ যেন সর্বদাই স্পষ্ট। দ্রুততা যেন তাঁর ফিল্ডিং দক্ষতাকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিতো। সেই সাথে তাঁর শক্তিশালী বাহু যেন ছিল প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের আতঙ্ক। মিলি সেকেন্ডের ভুলের ফায়দা সাইমন্ডস তুলে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করতেন না।
ক্ষিপ্রতা আর পেশিশক্তি ব্যবহার এই দুই মিলিয়ে তিনি ছিলেন অস্ট্রেলিয়া দলের সে আমলের অন্যতম ভরসাযোগ্য ফিল্ডার। শুধু ফিল্ডার হিসেবেই নন। তিনি ব্যাট হাতেও ছিলেন সমান পারদর্শী এবং ভরসাযোগ্য একজন ক্রিকেটার। সব অধিনায়কের সে সময়ের চাহিদার একটা বিরাট অংশ জুড়েই ছিল সাইমন্ডসের মত একজন ‘কমপ্লিট ক্রিকেটার’। তবে সবার ভাগ্যে তো আর সাইমন্ডস জুটে না।
অস্ট্রেলিয়া সেদিক থেকে নিজেদেরকে খানিকটা ভাগ্যবান মনে করতেই পারে। তবে ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়া বরাবরই ভাগ্যবান, দাপুটে এক পরাশক্তি। সাইমন্ডসরা ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষকে তুলোধুনো করতেন বলেই বোধকরি অস্ট্রেলিয়া নিজেদেরকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে বিশ্ব ক্রিকেটে। সাইমন্ডসের সময়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে গড় স্ট্রাইকরেট ছিল ৭৪ আর প্রায় প্রতি ১০৯ বল পর ছক্কার দেখা মিলত।
তবে সে সময়ে বাকি সবার থেকে এগিয়ে থেকেছেন সাইমন্ডস। তাঁর স্ট্রাইকরেট ছিল ৯২.৫। আর প্রায় ৫৩ বল পর পর তিনি ছক্কা হাঁকাতে পারতেন। এটাই তাঁর মারকাটারি ব্যাটিং দক্ষতার পক্ষে প্রমাণ দেয়। ওয়ানডে ক্রিকেটও বর্তমানে বেশ রানবন্যা দেখা যায়। এই যুগে পদার্পণ করার আগেই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন সাইমন্ডস। তবুও তিনি পাঁচ হাজার রান করা ব্যাটারদের মধ্যে স্ট্রাইকরেট বিবেচনায় রয়েছেন একাদশতম অবস্থানে।
সময়ের থেকে এগিয়ে তিনি ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি হয়ত একজন লাগাম ছাড়া ঘোরা হয়ে বাইশ গজে রানমেশিন হতে পারতেন, যদি তাঁকে তাঁর মত করেই খেলতে দেওয়া হত। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সমাপ্তিতে মাত্র তিনজন ব্যাটারের স্ট্রাইকরেট ছিল ১০০। বীরেন্দ্র শেবাগ, শহীদ আফ্রিদি ও এবি ডি ভিলিয়ার্সের থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি রয়েছে সাইমন্ডসের। তবুও তিনি এদের থেকে রইলেন খানিক পিছিয়ে।
তবে সার্বিক চিত্রংকনে তিনি কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। তিনি ছিলেন সবার আগে এবং সময়ের আগে তো বটেই। তিনি একাধারে অফস্পিন বোলিং করতেন আবার মিডিয়াম পেস বোলিংও করতেন। দল যখন তাঁর কাছ থেকে যা চেয়েছে তিনি যেন তাই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তিনি নিয়মিত দলের পাঁচ বোলারদের কেউ ছিলেন না। বরং একজন পার্টটাইমার হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন।
তবুও ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে রয়েছে ১৩৩টি উইকেট। আফসোস টি-টোয়েন্টির জৌলুশ শুরু হওয়ার আগেই সাইমন্ডস পৌঁছে গিয়েছিলেন নিজের গোধূলি লগ্নে। তিনি আর নিজের সেই পেশিশক্তির দারুণ সব শট দিয়ে আমাদের আনন্দে ভাসাতে পারেননি লম্বা সময় ধরে। তবে তিনি এখানটাও তো আর ব্যর্থ নন। সব ধরণের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মিলিয়ে তিনি ১৪৭ এর একটু বেশি স্ট্রাইকরেটে রান করে গেছেন।
নিজের ক্রিকেট নামক গাড়িটার জ্বালনি শেষ হওয়ার আগ অবধি তিনি সেটা ক্রিকেটের অসীম পথে চালিয়ে গেছেন। তবে হ্যাঁ তাঁর জীবন নামক গাড়িটা থেমে গেছে। এই পৃথিবী নামক গোলকে তিনি এখন এক অতীত।